ভারত থেকে বাংলাদেশে ‘পুশ ইনের’ শিকার হওয়া আলোচিত সখিনা বেগমকে অবশেষে জামিন দিয়েছেন আদালত। রবিবার (২৩ নভেম্বর) বিকেলে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইনের আদালত এই আদেশ দেন। ৬৮ বছর বয়সী এই বৃদ্ধার জামিনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ মাস ধরে চলা এক মানবিক ও আইনি জটিলতার আপাত অবসান হলো।
এই বৃদ্ধাকে গত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ জোরপূর্বক বাংলাদেশের ভেতরে ঠেলে দিয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। সখিনা বেগমের পক্ষে আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আইনজীবী অ্যাডভোকেট রহমাতুল্যাহ সিদ্দিক।
আদালতে সখিনা বেগমের উপস্থিতি ও জামিন প্রক্রিয়া
রবিবার সকালে সখিনা বেগমকে কঠোর নিরাপত্তায় আদালতের হাজতখানায় আনা হয়।
হাজিরা: এদিন সকাল ৯টায় সখিনা বেগমকে আদালতের হাজতখানায় আনা হয়। পরে দুপুর পৌনে ২টায় জামিন শুনানির জন্য তাঁকে আদালতে তোলা হয়।
আইনজীবী ও যুক্তিতর্ক: সখিনা বেগমের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অ্যাডভোকেট রহমাতুল্যাহ সিদ্দিক। তিনি আদালতে এই বৃদ্ধার মানবিক দিক এবং জোরপূর্বক পুশ ইনের শিকার হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন।
আদালতের সিদ্ধান্ত: যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে বিকেলে অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইন তাঁর জামিন মঞ্জুর করেন। এর আগে গত ১০ নভেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালতে জামিন আবেদন করা হলেও সেবার তা মঞ্জুর হয়নি। ফলে তাঁকে জেলখানাতেই থাকতে হয়েছিল।
সখিনা বেগমের পুশ ইনের
সখিনা বেগমের এই ঘটনাটি প্রথম সামনে আসে যখন তাঁকে বাংলাদেশের ঢাকার মিরপুরে খুঁজে পায় একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। তখন তিনি ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মাধ্যমে জোরপূর্বক সীমান্তের এপারে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন।
আসাম পুলিশ কর্তৃক আটক: সখিনা বেগমকে সাড়ে পাঁচ মাস আগে, অর্থাৎ গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে ভারতের আসাম পুলিশ আটক করেছিল। তখন তাঁকে আসামের নলবাড়ি জেলার বরকুড়া গ্রামের বাসা থেকে পুলিশ নিয়ে যায়।
পরিবারকে না জানানো: আসাম পুলিশ তাঁকে আটকের পর পরিবারকে কিছুই জানায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিএসএফের হাতে হস্তান্তর: আসাম পুলিশ তাঁকে আটকের পর দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করে। এরপরই তাঁকে জোরপূর্বক বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়।
সাংবাদিকতার মাধ্যমে উন্মোচন
সখিনা বেগমের এই পুশ ইনের ঘটনাটি সংবাদমাধ্যমে উঠে আসার পর এটি ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করে।
বিবিসি বাংলার সন্ধান: গত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে সখিনা বেগমকে বাংলাদেশের ঢাকার মিরপুরে খুঁজে পায় বিবিসি। এই বৃদ্ধা তখন জানিয়েছিলেন, ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাঁকে সীমান্তের এপারে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে।
ভারতে পরিবারের সন্ধান: তাঁর দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী ভারতে বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা অমিতাভ ভট্টশালী আসামে গিয়ে সখিনা বেগমের পরিবারকে খুঁজে পান। তাঁর পরিবারও নিশ্চিত করে যে, সখিনা বেগম দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের বাসিন্দা ছিলেন এবং তাঁকে জোর করে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
জাতীয়তা বিতর্ক: এই ঘটনাটি দুই দেশের সীমান্ত এলাকায় জাতীয়তা যাচাই এবং অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি করে। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্ন ওঠে যে, একজন ৬৮ বছর বয়সী বৃদ্ধাকে কেন এভাবে সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেওয়া হলো।
আইনজীবীর মন্তব্য ও আইনি জটিলতা
সখিনা বেগমের জামিন পাওয়ায় তাঁর আইনজীবী স্বস্তি প্রকাশ করেছেন, তবে এই ঘটনার আইনি জটিলতা সহজে শেষ হওয়ার নয়।
মানবিক জামিন: অ্যাডভোকেট রহমাতুল্যাহ সিদ্দিক জামিন পাওয়ার পর জানান, আদালত এই বৃদ্ধার শারীরিক অবস্থা ও মানবিক দিকটি বিবেচনা করে জামিন মঞ্জুর করেছেন। তিনি দীর্ঘ সময় আইনি প্রক্রিয়ায় থাকার কারণে প্রচণ্ড মানসিক ও শারীরিক ভোগান্তির শিকার হয়েছেন।
ভবিষ্যৎ আইনি লড়াই: জামিন পেলেও সখিনা বেগমের বিরুদ্ধে থাকা অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলাটি এখনো চলমান। এই মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আইনি জটিলতা থেকেই যাবে। আইনজীবীর মতে, এটি একটি আন্তর্জাতিক সংবেদনশীল মামলা, যেখানে পুশ ইন প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে।
অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইন: (আদেশের সারাংশ) “আদালত এই বৃদ্ধার বয়স এবং মানবিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাঁর জামিন মঞ্জুর করার নির্দেশ দেন।”
দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের প্রত্যাশা
ভারত থেকে জোরপূর্বক ‘পুশ ইনের’ শিকার হওয়া সখিনা বেগমের জামিন পাওয়া একটি মানবিক স্বস্তির খবর হলেও, এটি দুই দেশের সীমান্ত নীতি এবং মানবাধিকারের প্রশ্নকে আরও জোরালো করেছে। একজন বৃদ্ধ নাগরিককে তাঁর পরিবারের অজান্তে অন্য দেশে ঠেলে দেওয়ার ঘটনাটি আন্তর্জাতিক প্রোটোকলের লঙ্ঘন হতে পারে। এই ঘটনাটি আবারও প্রমাণ করে যে, সীমান্ত এলাকায় অবৈধ অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে আটক ব্যক্তিদের দ্রুত জাতীয়তা যাচাই, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ এবং মানবিক দিকটি বিবেচনা করা কতটা জরুরি। সখিনা বেগমের মামলাটি আইনি প্রক্রিয়ায় চলতে থাকবে, তবে তাঁর জামিনের মধ্য দিয়ে তাঁর পরিবার সাময়িক স্বস্তি ফিরে পেল। এখন প্রয়োজন দুই দেশের সরকারের মধ্যে আলোচনা করে এই ধরনের ‘পুশ ইনের’ ঘটনার স্থায়ী ও মানবিক সমাধান নিশ্চিত করা।
এম আর এম – ২৩৪৩,Signalbd.com



