ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে কয়েকটি জেলায় অনুভূত মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প রাজধানীর শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সাধারণ মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। ঠিক এমন প্রেক্ষাপটে দেশ, সমাজ ও পুরো মানবতার জন্য আল্লাহর রহমত কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজন করা হয়েছে নফল নামাজ ও বিশেষ দোয়া মাহফিল।
রোববার, ২৪ নভেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী হাজি মুহম্মদ মুহসীন হলের মাঠে অনুষ্ঠিত হবে এ সম্মিলিত প্রার্থনা। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মপ্রাণ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ আগ্রহী সকলকে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
ভূমিকম্পের আতঙ্ক ও শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েক দফা ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। ভূতাত্ত্বিক জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলের ওপর অবস্থান করছে এবং রাজধানী ঢাকাও ঝুঁকিপূর্ণ নগরী হিসেবে চিহ্নিত। ভূমিকম্পপ্রবণ ‘মেঘালয় ফল্ট’, ‘ডফলা ফল্ট’ ও ‘মিয়ানমার প্লেট বাউন্ডারি’র নিকটবর্তী হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন ধরেই বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকির কথা বলে আসছেন।
এই বাস্তবতা শিক্ষার্থীদের মধ্যেও স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্ক তৈরি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ায় রাতেও অনেক শিক্ষার্থী নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেননি। কিছু হলে নিরাপত্তা আলোচনা, সচেতনতা সভা পর্যন্ত করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আধ্যাত্মিক শান্তি ও মানসিক স্বস্তির জন্য এই দোয়া মাহফিল নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।
আয়োজক শিক্ষার্থীদের বক্তব্য
আয়োজকদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেয়াদুল ইসলাম জুবাহ বলেন,
“প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের অসহায়ত্বকে ফুটিয়ে তোলে। প্রযুক্তি, স্থাপত্য কিংবা প্রশাসনিক প্রস্তুতি থাকলেও দুর্যোগের পুরো ঝুঁকি কখনোই শেষ হয় না। তাই আমরা আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা, শান্তি ও রহমত কামনা করছি। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনা ও মানবিক সংহতি বাড়ানোর জন্যও এই আয়োজন করা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন,
“ভয় নয়, সচেতনতা ও আস্থা তৈরি করাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা বিশ্বাস করি, সম্মিলিত দোয়া মানুষের মনে সান্ত্বনা এনে দেয় এবং সকলকে একসূত্রে গেঁথে রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ যেন শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ থাকে—এ কামনাতেও এই আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ।”
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
যদিও এটি শিক্ষার্থীবান্ধব আয়োজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এমন উদ্যোগ মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
একজন সিনিয়র শিক্ষক বলেন,
“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবসময় সামাজিক-মানবিক উদ্যোগে এগিয়ে আসে। প্রাকৃতিক ঝুঁকি নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন, কিন্তু আতঙ্ক নয়—তারা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছে। সম্মিলিতভাবে শান্তি কামনার এ আয়োজন তাদের মানবিক মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ।”
অন্য একজন কর্মকর্তা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় এবার জরুরি দুর্যোগ প্রস্তুতি–সংক্রান্ত সচেতনতা ও প্রশিক্ষণের ওপরও জোর দিচ্ছে। কারণ যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি কমাতে প্রস্তুতিই সবচেয়ে বড় শক্তি।
নফল নামাজের তাৎপর্য
ইসলাম ধর্মে নফল নামাজকে বলা হয় স্বেচ্ছা ইবাদত। এটি ফরজ বা বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু আল্লাহর নৈকট্য অর্জন ও মনকে প্রশান্ত করতে এ ইবাদতের গুরুত্ব অপরিসীম।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মুক্তি, রোগ–ব্যাধি থেকে সুরক্ষা, বিপদ–আপদ থেকে রক্ষা কামনায় মুসলমানরা বিভিন্ন সময়ে নফল নামাজ আদায় করে থাকেন।
বাংলাদেশের গ্রাম–শহর উভয় জায়গায় যখনই বড় কোনো প্রাকৃতিক পরিস্থিতি দেখা দেয়—ঝড়, বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি বা ভূমিকম্প—মানুষ মসজিদে বা খোলা মাঠে সম্মিলিতভাবে দোয়া ও নফল নামাজ আদায় করে। এটি শুধু ধর্মীয় অনুষঙ্গ নয়, বরং সামাজিক বন্ধনকেও দৃঢ় করে।
অনুষ্ঠানের কাঠামো
আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে,
- সকাল সাড়ে ১০টায় নফল নামাজ শুরু হবে
- নামাজ শেষে দেশ, জাতি ও সমগ্র মানবতার নিরাপত্তা, শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য বিশেষ দোয়া করা হবে
- দোয়া পরিচালনা করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সম্মানিত শিক্ষক বা মসজিদের ইমাম
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সচেতনতা ও পরামর্শ নিয়ে কয়েক মিনিটের বক্তব্য থাকবে
অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া সবার জন্য হলো প্রাঙ্গণে সুবিন্যস্ত ব্যবস্থা রাখা হবে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ–সচেতনতা ও প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে জনবহুল নগরীতে অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ, দুর্বল ভবন কাঠামো এবং পরিকল্পনার অভাব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঐতিহাসিক ও ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় ঝুঁকি আরও বেশি।
তাই ভূমিকম্প প্রতিরোধী অবকাঠামো, নিরাপদ ভবন নির্মাণ, জরুরি উদ্ধার প্রশিক্ষণ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
দোয়া মানুষের ভরসা হলেও, প্রস্তুতিও সমান গুরুত্বপূর্ণ—এ নিয়ে আয়োজকরাও সচেতন।
একজন শিক্ষার্থী জানান,
“দোয়া করি, একই সঙ্গে চাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমিকম্প নিরাপত্তা নিয়ে নিয়মিত মহড়া ও প্রশিক্ষণ হোক। শুধু আলোচনা নয়, বাস্তবমুখী প্রস্তুতিও জরুরি।”
সম্মিলিত প্রার্থনা মানুষের মানসিক শক্তি বাড়ায়
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, দুর্যোগের সময় সম্মিলিত প্রার্থনা, ধর্মীয় সমাবেশ বা সামাজিক উদ্যোগ মানুষের ভয়-উদ্বেগ কমাতে ভূমিকা রাখে। এটি সমাজের মধ্যে একতা তৈরি করে এবং একে অপরের প্রতি আস্থা জাগায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সবচেয়ে বড় আবাসিক ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে প্রায় প্রতিদিনই নানান সামাজিক–সাংস্কৃতিক আয়োজন হয়। তবে এ ধরনের আধ্যাত্মিক উদ্যোগ শিক্ষার্থীদের মানসিক শক্তি বৃদ্ধিরও দৃষ্টান্ত।
মানবিক ও আধ্যাত্মিক আবেদনে পরিপূর্ণ একটি আয়োজন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক নতুন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, হলগুলোতে প্রথমবারের মতো বড় কোনো ভূমিকম্পের অনুভূতি পেয়ে তারা ভীত হয়ে পড়েছিলেন। বিশেষ করে রাতের বেলা ভবন দুলতে শুরু করলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এ অবস্থায় মানবিকতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক সংহতির বার্তা ছড়িয়ে দিতে নফল নামাজ ও দোয়া মাহফিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে তাদের বিশ্বাস।
দেশের সার্বিক শান্তি ও নিরাপত্তা কামনায় দোয়া
আয়োজকরা জানিয়েছেন, দোয়া মাহফিল শুধু ভূমিকম্প নয়, বরং
- দেশের সকল মানুষের নিরাপত্তা
- সমাজে শান্তি ও কল্যাণ
- অসহায় মানুষের সুরক্ষা
- জাতির সমৃদ্ধি ও সুখ
- বিশ্বব্যাপী মানবতার মঙ্গল
এ সবকিছুর জন্যই করা হবে।
দোয়া শেষে কয়েক মিনিট নীরব প্রার্থনাও রাখা হতে পারে।
ঢাবির শিক্ষার্থীদের উদ্যোগ দেশজুড়ে উদাহরণ হতে পারে
বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈতিক, মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ জোরদারের জন্য শিক্ষার্থীদের এ ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করছেন অনেক শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ আয়োজন অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেও ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
সবার উদ্দেশে আয়োজকদের বার্তা
“আমরা দুর্যোগ চাই না, আমরা চাই শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা। তাই যে যেভাবে পারেন, আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, প্রস্তুত থাকুন এবং অন্যকে সাহায্য করুন”—এমন বার্তাও দিয়েছেন সংগঠকরা।
MAH – 13932 I Signalbd.com



