বিশ্ব

আবারও গাজায় ইসরায়েলি হামলা, নিহত অন্তত ২৪

Advertisement

গাজায় আবারও ভয়াবহ বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। শনিবার ভোর থেকে রাত অবধি দফায় দফায় চলা এসব হামলায় শিশুসহ অন্তত ২৪ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও কমপক্ষে ৮৭ জন। আহতদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে গাজার চিকিৎসকরা।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সূত্রের বরাতে জানা যায়, উত্তর গাজা থেকে শুরু করে মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত অন্তত ১২টি স্থানে হামলা চালানো হয়েছে। টার্গেট করা হয়েছে আবাসিক ভবন, আশ্রয়কেন্দ্র, চলন্ত গাড়ি, বাজার এলাকা এবং নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরের বিভিন্ন অংশ।

গাজা সিটিতে ভয়াবহ পরিস্থিতি: এক পরিবারের ৭ সদস্য নিহত

সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে গাজা সিটিতে। এখানে অন্তত ১১ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ছিল তিন শিশু ও দুই নারী। হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া একটি আবাসিক ভবন থেকে একই পরিবারের সাতজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
উদ্ধারকারী দল—যারা অনেক সময় খালি হাতে ধ্বংসস্তূপ খুঁড়ে বাঁচার চেষ্টা করেন—তারা জানিয়েছেন, ভারি অস্ত্রের আঘাতে পুরো ভবনটি মুহূর্তেই ধসে পড়ে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন,
“হামলার আগে কোনো সতর্কবার্তা দেওয়া হয়নি। মানুষ ঘুমিয়ে ছিল, কেউ জানতেও পারেনি যে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পুরো এলাকা মাটির সঙ্গে মিশে যাবে।”

দেইর আল বালাহতে বাড়ি লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ, তিনজন নিহত

দক্ষিণ-মধ্য গাজার দেইর আল বালাহ এলাকায় এক আবাসিক বাড়িতে সরাসরি বোমা নিক্ষেপ করলে সেখানে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে তিনজন তাৎক্ষণিক মারা যান। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১২ জন। স্থানীয় মানুষ জানান, ওই বাড়িটি ছিল যুদ্ধ চলাকালীন অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র। সেখানে বেশ কয়েকটি পরিবার একসঙ্গে অবস্থান করছিল।

নুসেইরাত শরণার্থী শিবির আবারও টার্গেট

গাজার সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা নুসেইরাত শরণার্থী শিবির। এই শিবিরে অনেক আগেও হামলা হয়েছে; এবারও বাদ যায়নি। শনিবার বিকালে একটি বহু–তলা আবাসিক ভবন লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়। এতে অন্তত ৬ জন নিহত এবং ২০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।

শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দারা বলেন,
“প্রতিদিনই হামলা হচ্ছে। কোথাও নিরাপদ আশ্রয় নেই। হাসপাতাল, স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্র—কোনো জায়গা এখন আর নিরাপত্তার প্রতীক নয়।”

যুদ্ধবিরতি মানছে না ইসরায়েল: লঙ্ঘন ৪৯৭ বার

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি, গত ১০ অক্টোবর থেকে ইসরায়েল মোট ৪৯৭ বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে।
এই সময়ের মধ্যে নিহত হয়েছেন অন্তত ৩৪২ জন ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন আরও কয়েক হাজার মানুষ।

বিশ্বসংস্থার মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজায় এখন মানবিক সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। প্রয়োজনীয় ওষুধ, পরিচ্ছন্ন পানি, খাদ্য সরবরাহ—সবই দুর্লভ হয়ে উঠেছে। বোমা হামলার কারণে কার্যত অনেক এলাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় উদ্ধারকাজও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

ইসরায়েলের দাবি: ‘হামাস পাল্টা হামলা চালিয়েছে’

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) দাবি করেছে, হামাস যোদ্ধারা গাজা স্ট্রিপের উত্তরাঞ্চল থেকে ইসরায়েলি সেনাদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছিল। এর জবাবেই তারা “টার্গেটেড অপারেশন” পরিচালনা করেছে।

আইডিএফ আরও দাবি করেছে, এই অভিযানে হামাসের পাঁচজন সিনিয়র নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। তবে এই দাবি স্বাধীন কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা যাচাই করতে পারেনি। হামাস এখনো তাদের নেতাদের নিহত হওয়ার বিষয়ে কিছু জানায়নি।

চিকিৎসা সংকট চরম পর্যায়ে: হাসপাতাল প্রায় অকার্যকর

গাজার হাসপাতালে এখন রোগীর চাপ বহন করার মতো সক্ষমতা নেই। বিদ্যুৎ সংকট, ওষুধের ঘাটতি, চিকিৎসক-নার্সের অভাব—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ।

গাজা সিটির আল–শিফা হাসপাতালের একজন চিকিৎসক জানান,
“প্রতিদিন ডজন ডজন আহত আসে। অনেককেই চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ নেই। অপারেশন থিয়েটারে জায়গা নেই, ওষুধ নেই, বেড নেই। অনেক আহতকেই মেঝেতে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।”

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে, গাজার ৭০ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্র আংশিক বা পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে গেছে। ফলে আহতদের অধিকাংশই সময়মতো চিকিৎসা পাচ্ছেন না, যা মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

মানবিক সাহায্য বন্ধের পর্যায়ে: তীব্র খাদ্য সংকট

গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশের পথও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। রাফাহ সীমান্ত দিয়ে দিনে কয়েকটি ট্রাক প্রবেশ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজার প্রায় ২৩ লাখ মানুষ এখন খাদ্য, পানি ও আশ্রয়ের তীব্র সংকটে ভুগছেন।

গাজার একজন বাসিন্দা বলেন,
“শিশুর জন্য এক গ্লাস দুধও এখন বিলাসিতা। বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, বাজার নেই। সবকিছু ধ্বংস।”

বিশ্বের প্রতিক্রিয়া: উদ্বেগ বাড়ছে, নিষেধাজ্ঞার দাবি তীব্র

জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ এই নতুন হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
অনেক মানবাধিকার সংস্থা ইসরায়েলের ওপর অবিলম্বে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি তুলেছে।

তবে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে স্পষ্ট অবস্থান দেখা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ পুনর্ব্যক্ত করেছে, যদিও তারা বেসামরিক হতাহতের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

এদিকে তুরস্ক, কাতার, মিশরসহ কয়েকটি দেশ নতুন করে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার জন্য মধ্যস্থতা চালিয়ে যাচ্ছে।

বিশ্ব রাজনীতিতে গাজা ইস্যু: নতুন করে উত্তেজনা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজা ইস্যু এখন শুধু ইসরায়েল–ফিলিস্তিনের নয়, বরং বৈশ্বিক শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ইসরায়েলবিরোধী জনমত তীব্র হচ্ছে। আরব লিগ বলেছে, গাজায় বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্য করে হামলা “যুদ্ধাপরাধের শামিল”।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকের ভাষায়,
“প্রতিদিন ঘটতে থাকা হামলা শুধু মানুষ মারছে না, বরং পুরো অঞ্চলের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।”

গাজার মানুষের প্রশ্ন: ‘কোথায় শান্তি?’

হামলার পর ধ্বংসস্তূপের ওপর বসে থাকা ৯ বছরের এক শিশুকে প্রশ্ন করা হলে সে শুধু বলেছে—
“আমি শুধু ঘুমাতে চাই। আর বোমার শব্দ শুনতে চাই না।”

গাজার মানুষ প্রতিদিনই এই প্রশ্ন তুলছেন—এ যুদ্ধ কবে থামবে?

সর্বশেষ হামলার ঘটনায় গাজায় মানবিক সংকট আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে নিহত ও আহতের সংখ্যা। যুদ্ধবিরতি কার্যকর না হলে পরিস্থিতি যে আরও বিপর্যয়কর হবে—সেটাই এখন সবচেয়ে বড় আশঙ্কা।

ইসরায়েল ও হামাসের পাল্টাপাল্টি হামলা এবং আন্তর্জাতিক মহলের চাপ—সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের এই অবরুদ্ধ ভূখণ্ডটি আবারও অস্থিতিশীলতায় ডুবে আছে। আর সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হচ্ছে সাধারণ মানুষের—যারা প্রতিটি দিনের শুরু ও শেষ করছে মৃত্যু, ভয় এবং অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে।

MAH – 13929 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button