দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির তীব্রতা এখনও কমেনি। গত ২৪ ঘণ্টায় (শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও তিনজন (৩) রোগীর মৃত্যু হয়েছে। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে দু’জনই বরিশাল বিভাগের বাসিন্দা। একই সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে নতুন করে ৫৯৩ জন রোগী দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
শনিবার (২২ নভেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই উদ্বেগজনক তথ্য জানানো হয়েছে। এই নতুন মৃত্যুসহ চলতি বছর ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫৬ জনে, যা জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
২৪ ঘণ্টার ভর্তির তথ্য: কোন বিভাগে কতজন?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, গত একদিনে সারা দেশে মোট ৫৯৩ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই সংখ্যা যদিও আগের কয়েকদিনের তুলনায় কিছুটা কম, তবুও তা পরিস্থিতি যে এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে, সেই ইঙ্গিত দেয়।
নতুন ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকাতেই রোগীর চাপ সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা গেছে। রোগীর ভর্তির পরিসংখ্যান বিভাগ ও অঞ্চল অনুযায়ী নিম্নরূপ:
- ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি): ২১১ জন
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি): ৭৮ জন
- ঢাকা বিভাগ (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে): ৮৮ জন
- চট্টগ্রাম বিভাগ: ৯৭ জন
- বরিশাল বিভাগ: ৯০ জন
- খুলনা বিভাগ (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে): ২৯ জন
- অন্যান্য বিভাগ: এই বিভাগগুলোর বাইরে অন্যান্য জেলা ও অঞ্চলেও রোগীর ভর্তির ঘটনা রয়েছে।
বরিশাল বিভাগে একদিনে দুইজন রোগীর মৃত্যু হওয়ায় এবং সেখানে ৯০ জন নতুন রোগী ভর্তি হওয়ায় এটি দেশের ডেঙ্গু ঝুঁকির অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
২০২৫ সালের সামগ্রিক পরিসংখ্যান: মৃত্যু ও আক্রান্তের হার
২০২৫ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু পরিস্থিতির সামগ্রিক চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পরিস্থিতি গত কয়েক বছরের তুলনায় এখনও মারাত্মক পর্যায়ে রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৮৯ হাজার ৪৮৬ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এদের মধ্যে গত একদিনে সারা দেশে ৬২৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। সব মিলিয়ে চলতি বছর এ পর্যন্ত ৮৬ হাজার ৩৩১ জন রোগী সুস্থ হয়ে ছাড়পত্র নিয়েছেন।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, চলতি বছর ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা এখন ৩৫৬ জন। এই উচ্চ মৃত্যুহার প্রমাণ করে যে, ডেঙ্গুর নতুন ভ্যারিয়েন্ট এবং রোগের জটিলতা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যখাতে আরও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
পূর্ববর্তী বছরের সঙ্গে তুলনা: পরিস্থিতির ভয়াবহতা
চলতি বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি বুঝতে পূর্ববর্তী বছরগুলোর তথ্য পর্যালোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। ডেঙ্গু সংক্রমণের দিক থেকে ২০২৩ সাল ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বছর।
- ২০২৩ সালের পরিস্থিতি: ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। ওই বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ১ হাজার ৭০৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।
- ২০২৪ সালের পরিস্থিতি: ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুবরণ করেছেন ৫৭৫ জন।
২০২৫ সালের পরিসংখ্যান (৮৯ হাজার ৪৮৬ জন ভর্তি এবং ৩৫৬ জন মৃত্যু) ২০২৩ সালের তুলনায় কিছুটা কম হলেও, বছরের শেষ দিকে এসেও নতুন আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুর হার (প্রতিদিন গড়ে ৩ জনের মৃত্যু) পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক পর্যায়ে রাখছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নভেম্বর মাসেও এত বেশি সংখ্যক রোগী ভর্তি হওয়াটা অস্বাভাবিক।
ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির কারণ ও চ্যালেঞ্জ
দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ অব্যাহত থাকার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান কারণগুলো হলো:
১. জলবায়ু পরিবর্তন: মৌসুম পরিবর্তনের ধরনে আসা পরিবর্তন মশা বংশবৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। ২. অপরিকল্পিত নগরায়ণ: ঢাকা ও অন্যান্য নগরীতে মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যকরী উদ্যোগের অভাব এবং আবর্জনার স্তূপ জমে থাকা। ৩. এডিস মশার অভিযোজন: এডিস মশা এখন শুধু স্বচ্ছ জলেই নয়, বরং অন্যান্য নোংরা পরিবেশেও বংশবৃদ্ধি করছে। ৪. রোগের ভ্যারিয়েন্ট পরিবর্তন: ডেঙ্গুর একাধিক সেরোটাইপ (যেমন ডিইএনভি-৩, ডিইএনভি-৪) সক্রিয় থাকায় রোগীদের মধ্যে তীব্রতা ও জটিলতা বাড়ছে। ৫. স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা: আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসপাতালগুলোতে চাপ বাড়ছে, যা চিকিৎসাসেবার মানকে প্রভাবিত করছে।
বিশেষ উদ্বেগ: “গত একদিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৯৩ জন রোগী। তাদের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটিতে ২১১ জন এবং বরিশাল বিভাগে ৯০ জন।”
মৃত্যুহার কমাতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার কমিয়ে আনার জন্য বিশেষজ্ঞরা দ্রুত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর জোর দিয়েছেন:
- প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকরণ: ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলেই দ্রুততম সময়ে রক্ত পরীক্ষা করে রোগ নিশ্চিত করা।
- হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণ: ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের ক্ষেত্রে হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা।
- প্লাটিলেট-এর ব্যবহার: প্লাটিলেট-এর ব্যবহারের বিষয়ে সঠিক ক্লিনিকাল গাইডলাইন অনুসরণ করা।
- মশা নিধন কার্যক্রম: সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে মশা নিধন কার্যক্রমে আরও আধুনিক ও কার্যকর পদ্ধতি ব্যবহার করা।
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি: বাড়ির ভেতরে ও আশেপাশে যেন পানি জমে না থাকে, সেই বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা।
দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা জরুরি
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৩ জনের মৃত্যু এবং ৫৯৩ জন নতুন রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রমাণ করে যে, ডেঙ্গু এখন আর শুধু বর্ষাকালের সমস্যা নয়, বরং এটি বারো মাসই উদ্বেগের কারণ। বিশেষত, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের মতো অঞ্চলে এর প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় এটি আর শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক সমস্যা নেই। এই পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু মোকাবিলায় একটি দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করা আবশ্যক, যেখানে বছরজুড়ে মশা নিয়ন্ত্রণ, জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে বিনিয়োগ নিশ্চিত করা হবে। অন্যথায়, প্রতি বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে তা দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য আরও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
এম আর এম – ২৩৩১,Signalbd.com



