বাংলাদেশ

সাড়ে ৩১ ঘণ্টায় চারবার ভূমিকম্প:, নিহত ১০, আহত ছয় শতাধিক

Advertisement

দেশের ভূতাত্ত্বিক কাঠামোতে অস্থিরতা বাড়ছে। গত সাড়ে ৩১ ঘণ্টার ব্যবধানে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চারবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এই ঘন ঘন ভূ-কম্পন সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে গতকাল শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকালে আঘাত হানা তুলনামূলক শক্তিশালী ভূমিকম্পের প্রভাবে শিশুসহ অন্তত ১০ জন নিহত এবং ছয় শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

সবশেষ শনিবার (২২ নভেম্বর) সন্ধ্যায় মাত্র এক সেকেন্ডের ব্যবধানে পরপর দু’বার মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। এই ঘন ঘন কম্পনগুলো বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকির বিষয়টি নতুন করে সামনে এনেছে।

চারবার ভূমিকম্পের সময় ও মাত্রা

গত সাড়ে ৩১ ঘণ্টার মধ্যে ঘটে যাওয়া চারটি ভূমিকম্পের সময়, উৎপত্তিস্থল এবং মাত্রা নিচে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:

  • ১ম কম্পন (শুক্রবার): সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে মাঝারি মাত্রার এই ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫.৭। এর উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদী এলাকায়। এই কম্পনটি রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে তীব্রভাবে অনুভূত হয় এবং এতেই সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটে।
  • ২য় কম্পন (শনিবার সকাল): সকাল ১০টা ৩৬ মিনিট ১২ সেকেন্ডে মৃদু এই ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৩.৩। এটির উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর পলাশ উপজেলায়।
  • ৩য় কম্পন (শনিবার সন্ধ্যা): সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে এই ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৩.৭। এই কম্পনটির উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার বাড্ডা এলাকায়।
  • ৪র্থ কম্পন (শনিবার সন্ধ্যা): এর ঠিক এক সেকেন্ড পর, সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৫ সেকেন্ডে এটি অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এটির মাত্রা ছিল ৪.৩। আবহাওয়া অধিদপ্তর এটিকে নরসিংদী বা বাড্ডার কাছাকাছি উৎপত্তিস্থল বলে জানিয়েছে।

শুক্রবারের ভূমিকম্প: প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির চিত্র

শুক্রবার সকালে আঘাত হানা ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পটি সারাদেশে ব্যাপক আতঙ্ক ও ক্ষয়ক্ষতি সৃষ্টি করে। এই কম্পনে বিভিন্ন স্থানে ভবন হেলে পড়া বা ফাটল দেখা দেওয়ার খবর পাওয়া যায়। সবচেয়ে মর্মান্তিক হলো, এই দুর্যোগে শিশুসহ অন্তত ১০ জন নিহত হন।

নিহতদের মধ্যে পাঁচজনই নরসিংদী জেলার বাসিন্দা। এছাড়া ঢাকায় চারজন এবং নারায়ণগঞ্জে একজন মারা যান। নিহতদের বেশিরভাগই আতঙ্কে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে অথবা মাথায় ইট বা অন্যান্য বস্তু খসে পড়ার কারণে আঘাত পেয়েছিলেন। সারাদেশে আতঙ্কে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়া ও অন্যান্য দুর্ঘটনায় ছয় শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। এই হতাহতের ঘটনা দেশের দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং ভবনের কাঠামোগত দুর্বলতা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলেছে।

শনিবার সন্ধ্যার জোড়া কম্পন: বাড্ডা ও নরসিংদীর যোগসূত্র

শনিবার সন্ধ্যায় মাত্র এক সেকেন্ডের ব্যবধানে পরপর দুটি ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার ঘটনাটি ভূতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, প্রথমটির উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার বাড্ডা এবং দ্বিতীয়টিও কাছাকাছি কোনো স্থানে (নরসিংদী বা বাড্ডা) হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে এবং কাছাকাছি উৎপত্তিস্থলে বারবার কম্পন অনুভূত হওয়া ইঙ্গিত দেয় যে, এই অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ প্লেটগুলোতে চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই চাপ মুক্তির প্রক্রিয়াটি বড় কোনো ভূমিকম্পের পূর্বাভাস কি না, তা নিয়ে ভূতত্ত্ববিদরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। ঢাকার অভ্যন্তরে বা এর নিকটবর্তী স্থানে কম্পনের উৎপত্তিস্থল হওয়া রাজধানী এবং এর ঘনবসতিপূর্ণ কাঠামোর জন্য তীব্র ঝুঁকির সংকেত বহন করে।

জনমনে আতঙ্ক: প্রস্তুতি বনাম বাস্তবতা

গত দুই দিনের ঘন ঘন ভূমিকম্পের কারণে ঢাকা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে জনমনে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে শুক্রবারের প্রাণহানির ঘটনার পর শনিবার সন্ধ্যার জোড়া কম্পনে অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে বা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।

ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে জনগণের মধ্যে আতঙ্কিত হওয়ার প্রবণতা হতাহতের সংখ্যা বাড়াতে পারে। এই পরিস্থিতিতে জরুরি জনসচেতনতা কার্যক্রমের মাধ্যমে ভূমিকম্পের সময় সঠিক করণীয় সম্পর্কে মানুষকে বারবার অবহিত করা প্রয়োজন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় মানসিক প্রস্তুতি এবং সঠিক আচরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান: “শুক্রবার সকালের ভূমিকম্পে শিশুসহ ১০ জন নিহত ও ছয় শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি—পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে নরসিংদীতে।”

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ: কেন এত ঘন ঘন কম্পন?

ভূতত্ত্ববিদ ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের ঘন ঘন ভূমিকম্পের ঘটনাটিকে উদ্বেগের সঙ্গে দেখছেন। বাংলাদেশ দুটি প্রধান ভূ-পতিকার প্লেটের সংযোগস্থলের কাছে অবস্থিত। এই প্লেটগুলোতে সঞ্চিত শক্তি নিয়মিত বিরতিতে মৃদু কম্পনের মাধ্যমে মুক্ত হতে পারে, অথবা বড় কম্পনের মাধ্যমে হঠাৎ মুক্তি পেতে পারে।

সাম্প্রতিক এই চারটি কম্পন (৫.৭, ৩.৩, ৩.৭ এবং ৪.৩ মাত্রার) ইঙ্গিত দেয় যে, এই অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ শক্তির নিঃসরণ প্রক্রিয়া সক্রিয় রয়েছে। তারা সতর্ক করে বলেন, বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ না করা এবং উদ্ধার তৎপরতার দুর্বলতা বড় ধরনের ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে ব্যাপক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। দ্রুত ভবনগুলোর কাঠামোগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি পরিকল্পনা হালনাগাদ করা জরুরি।

দুর্যোগ প্রস্তুতিতে জাতীয় অগ্রাধিকার

মাত্র সাড়ে ৩১ ঘণ্টার মধ্যে চারবার ভূমিকম্প অনুভূত হওয়া এবং এতে ১০ জনের প্রাণহানি প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকির ক্ষেত্রে একটি মারাত্মক নাজুক অবস্থানে রয়েছে। ঘন ঘন কম্পনগুলো ভবিষ্যতে বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগমনী বার্তা হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে সরকারকে অবশ্যই দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং ব্যবস্থাপনাকে জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। কেবল আতঙ্কিত না হয়ে, ভূমিকম্প সহনশীল অবকাঠামো নিশ্চিত করা, জরুরি উদ্ধারকারী দলগুলোকে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং জনসচেতনতা কার্যক্রম জোরদার করার মাধ্যমেই ভবিষ্যতে বড় ধরনের প্রাণহানি ঠেকানো সম্ভব। দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষায় এখন আর কালক্ষেপণের সুযোগ নেই।

এম আর এম – ২৩২৮,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button