গত দুই দিনে টানা তৃতীয়বারের মতো দেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। সর্বশেষ শনিবার (২২ নভেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের অঞ্চলে পরপর দু’বার ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তর নিশ্চিত করেছে, সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিটের দিকে মাত্র এক সেকেন্ডের ব্যবধানে দুটি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে প্রথমটির মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৩.৭ এবং দ্বিতীয়টির মাত্রা ছিল ৪.৩। দু’টি ভূমিকম্পেরই উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার বাড্ডা এলাকা। ঘন ঘন এই ভূ-কম্পন অনুভূত হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
শনিবার সন্ধ্যার ভূ-কম্পনের বিস্তারিত তথ্য
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার সন্ধ্যায় এক সেকেন্ডের বিরতিতে দুটি ভিন্ন মাত্রার ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। এই ঘটনাটি দেশের ভূতাত্ত্বিক পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
প্রথম ভূ-কম্পনটি অনুভূত হয় ঠিক সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৩.৭। এর ঠিক এক সেকেন্ড পরে, অর্থাৎ সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৫ সেকেন্ডে দ্বিতীয় ভূ-কম্পনটি অনুভূত হয়, যার মাত্রা ছিল ৪.৩। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ঢাকা মহানগরীর ভেতরে বাড্ডা অঞ্চলে হওয়ায় রাজধানীতে এর প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি অনুভূত হয়েছে। অল্প সময়ের ব্যবধানে পরপর দুটি ভূ-কম্পন অনুভূত হওয়ার ঘটনা রাজধানীতে বিরল।
দুই দিনে তৃতীয় কম্পন: অস্থির ভূতাত্ত্বিক পরিস্থিতি
শনিবার সন্ধ্যায় এই দুটি ভূ-কম্পনের আগে একই দিন সকালে একবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল। সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে অনুভূত হওয়া মৃদু ওই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর পলাশ এবং এর মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৩.৩।
ফলে, মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে, অর্থাৎ শুক্রবার ও শনিবার মিলিয়ে, দেশে মোট চারবার ভূমিকম্প অনুভূত হলো। এই ঘন ঘন ভূ-কম্পন ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তর এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ভূতাত্ত্বিক প্লেটগুলোতে চাপের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় উদ্বেগের কারণ।
পূর্ববর্তী দিনের মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের প্রভাব
শনিবারের এই কম্পনগুলোর একদিন আগে, অর্থাৎ শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকালে দেশ একটি মাঝারি মানের ভূমিকম্পের শিকার হয়েছিল। ওইদিন সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটের দিকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। এর কেন্দ্রস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদী এলাকায়।
শুক্রবারের সেই তুলনামূলক শক্তিশালী ভূমিকম্পের ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে এই ভূমিকম্পের কারণে ১০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এছাড়াও, ভবন থেকে মাথায় ইট খসে পড়া এবং আতঙ্কে বহুতল ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে সারাদেশে অন্তত চার শতাধিক মানুষ আহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এই হতাহতের ঘটনা দেশের দুর্বল ভূমিকম্প সহনশীল অবকাঠামোগুলোর ভঙ্গুরতা স্পষ্ট করে তুলেছে।
ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল এবং ঝুঁকিপূর্ণ ঢাকা
ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সবসময় আলোচনা থাকে। সাম্প্রতিক এই ভূমিকম্পগুলোর কেন্দ্রস্থল ঢাকার অভ্যন্তরে (বাড্ডা) বা নিকটবর্তী নরসিংদী অঞ্চলে হওয়ায় ঢাকা মহানগরীর ঝুঁকি বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন যে, ঢাকা শহরটি এমন একটি ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে, যা বড় ধরনের ভূমিকম্পের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ। অপরিকল্পিত নগরায়ন, বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মাণ এবং দুর্বল উদ্ধার ও ত্রাণ ব্যবস্থার কারণে একটি মাঝারি মানের ভূমিকম্পও এখানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে পারে। বারবার ঢাকার কাছাকাছি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হওয়া ভবিষ্যতের জন্য একটি মারাত্মক সতর্কবার্তা।
“শনিবার সন্ধ্যায় এক সেকেন্ডের ব্যবধানে ২ বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এরমধ্যে প্রথম ভূ-কম্পনটি অনুভূত হয় সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে। মাত্রা ছিল ৩.৭। এরপর ফের সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৫ সেকেন্ডে দ্বিতীয় ভূ-কম্পনটি অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৪.৩। উভয় কম্পনের উৎপত্তিস্থল ঢাকার বাড্ডা।”
জনমনে আতঙ্ক ও করণীয়
ঘন ঘন ভূমিকম্পের কারণে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক বিরাজ করছে। শুক্রবারের ভূমিকম্পে হতাহতের ঘটনা এই আতঙ্ককে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই বাড়ি বা উঁচু ভবন ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে বা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে দেখা গেছে।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উচিত, সাধারণ মানুষের আতঙ্ক কমাতে সঠিক তথ্য প্রচার করা এবং ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো। ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কিত না হয়ে, নিজেকে ও অন্যকে সুরক্ষিত রাখতে দ্রুত ও সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য জনসচেতনতা অত্যন্ত জরুরি।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ এবং সতর্কতা
ভূতত্ত্ববিদরা মনে করেন, বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে (সিলেট-ময়মনসিংহ) এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে (চট্টগ্রাম-কক্সবাজার) ভূ-গর্ভস্থ প্লেটে বড় ধরনের চাপ জমা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সাম্প্রতিক কম্পনগুলো এই জমা হওয়া চাপেরই বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা দ্রুত ভূমিকম্প সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ নিশ্চিত করা, পুরনো ভবনগুলোর কাঠামোগত পরীক্ষা করা এবং একটি কার্যকর জাতীয় দুর্যোগ পরিকল্পনা প্রস্তুত রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে এই সতর্কতাগুলোকে আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সময়ের দাবি।
দুর্যোগ প্রস্তুতিতে জোর দেওয়া আবশ্যক
মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে বারবার ভূমিকম্প অনুভূত হওয়া এবং অল্প সময়ের ব্যবধানে ঢাকার অভ্যন্তরে দুটি কম্পন হওয়া বাংলাদেশের জন্য একটি মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইঙ্গিত। শুক্রবারের ভূমিকম্পে ১০ জনের প্রাণহানি প্রমাণ করে যে, দেশের অবকাঠামো বড় কম্পন সহ্য করার জন্য প্রস্তুত নয়। এখন সময় এসেছে কেবল সতর্ক থাকার নয়, বরং দুর্যোগ প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার। সরকার, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগে একটি ভূমিকম্প সহনশীল বাংলাদেশ গড়ার দিকে দ্রুত মনোনিবেশ করতে হবে। অন্যথায়, ভবিষ্যতে বড় কোনো ভূমিকম্পে আরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এম আর এম – ২৩২৭,Signalbd.com



