বিশ্ব

সুদানের কর্দোফান অঞ্চলে মানবিক বিপর্যয়: ১ মাসের মধ্যে অপুষ্টিতে ২৩ শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু

Advertisement

ধ্বংসাত্মক গৃহযুদ্ধ-বিধ্বস্ত সুদানের মধ্যাঞ্চলে এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে অপুষ্টিজনিত কারণে অন্তত ২৩ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। দেশটির সামরিক বাহিনী এবং শক্তিশালী আধাসামরিক র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সের (আরএসএফ) মধ্যে দীর্ঘ ৩০ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা সংঘাতের ফলে তৈরি হওয়া তীব্র মানবিক বিপর্যয়ের এক ভয়ংকর চিত্র এটি। একটি মেডিকেল গ্রুপ এই মর্মান্তিক তথ্য নিশ্চিত করেছে, যা উত্তর-পূর্ব আফ্রিকান দেশটিতে দুর্ভিক্ষের প্রসারকে স্পষ্ট করে তুলেছে।

অবরোধ ও সরবরাহের ঘাটতি

সুদানের স্বাস্থ্যকর্মী ও পেশাদারদের একটি সংস্থা সুদান ডক্টরস নেটওয়ার্ক (SDN) এই শিশু মৃত্যুর ঘটনা সামনে এনেছে। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০ অক্টোবর থেকে ২০ নভেম্বরের মধ্যে সুদানের কর্দোফান অঞ্চলের অবরুদ্ধ কাদুগলি শহর এবং ডিলিং শহরে এই ২৩ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

SDN জানিয়েছে, এই শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হল তীব্র অপুষ্টি এবং প্রয়োজনীয় জীবন রক্ষাকারী সরবরাহের চরম ঘাটতি। সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে সামরিক অবরোধের কারণে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য মানবিক সাহায্য প্রবেশে মারাত্মকভাবে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা, তীব্র ঝুঁকির মুখে পড়েছে। প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও চিকিৎসার অভাবে কর্দোফান ও দারফুর অঞ্চলের শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকে বিপর্যয়

সুদানে এই ভয়াবহ অরাজকতা শুরু হয় ২০২৩ সালের এপ্রিলে। দেশটির সামরিক বাহিনী (সুদান সশস্ত্র বাহিনী) এবং শক্তিশালী আধাসামরিক গোষ্ঠী আরএসএফ-এর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব রাজধানী খার্তুম এবং দেশের অন্যান্য স্থানে প্রকাশ্য লড়াইয়ের জন্ম দেয়। এই দুই প্রভাবশালী শক্তির মধ্যে বিরোধ শুরু হয় মূলত দেশের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং সেনাবাহিনীর ভবিষ্যৎ কাঠামো নিয়ে।

এই ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ দ্রুতই রাজধানী থেকে অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে দেশের ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ও খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। সামরিক ও আধাসামরিক গোষ্ঠীর মধ্যে চলমান লড়াইয়ে শুধু বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানিই ঘটেনি, বরং দেশটি এখন বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সংকটের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের পরিসংখ্যান ও বাস্তুচ্যুতি

সংঘর্ষের তীব্রতা ও এর ফলে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের পরিসংখ্যান অত্যন্ত উদ্বেগজনক। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই যুদ্ধে এ পর্যন্ত ৪০,০০০ এরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। তবে সাহায্যকারী গোষ্ঠীগুলো মনে করছে, সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলের প্রবেশাধিকার না থাকায় প্রকৃত নিহতের সংখ্যাটি এর চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে।

নিহতের সংখ্যার পাশাপাশি বাস্তুচ্যুতির চিত্রও ভয়াবহ। এই যুদ্ধে ইতোমধ্যে ১ কোটি ৪০ লক্ষেরও বেশি মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। এদের অনেকে দেশের ভেতরেই স্থানান্তরিত হয়েছেন, আবার অনেকে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হওয়া এই বিপুল সংখ্যক মানুষ আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে চরম কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।

দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি এবং খাদ্য সংকট

সুদানে খাদ্য সংকটের তীব্রতা এখন দুর্ভিক্ষে রূপ নেওয়ার পর্যায়ে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষুধা বিশেষজ্ঞরা এই বিষয়ে বারবার সতর্ক করেছেন। তাদের মতে, সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত কেবল কর্দোফান এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় দারফুরে প্রায় ৩ লাখ ৭০ হাজার মানুষ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছেন।

এছাড়াও, আরও প্রায় ৩৬ লক্ষ মানুষ দুর্ভিক্ষের কবল থেকে মাত্র এক ধাপ দূরে রয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। সংঘাতের কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, বাজার ব্যবস্থা ভেঙে পড়া এবং মানবিক সাহায্য পৌঁছাতে না পারার ফলেই খাদ্য নিরাপত্তার এই মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। শিশুরা অপুষ্টির কারণে মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং তাদের জীবন চরম ঝুঁকিতে রয়েছে।

“২০ অক্টোবর থেকে ২০ নভেম্বরের মধ্যে অবরুদ্ধ কাদুগলি শহর এবং ডিলিং শহরে তীব্র অপুষ্টি এবং প্রয়োজনীয় সরবরাহের ঘাটতির কারণে ২৩ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে।”— সুদান ডক্টরস নেটওয়ার্ক (SDN)

রোগের প্রাদুর্ভাব ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পতন

চলমান সংঘাতের ফলে শুধু খাদ্য সংকটই তৈরি হয়নি, বরং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো হয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা সেখানে কর্মীরা পৌঁছাতে পারছেন না। অপরিষ্কার পরিবেশ, নিরাপদ পানির অভাব এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে দেশটিতে রোগের প্রাদুর্ভাব আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে।

কলেরা, হাম এবং অন্যান্য পানিবাহিত রোগগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, যা অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের জন্য আরও বেশি মারাত্মক প্রমাণিত হচ্ছে। স্বাস্থ্য পরিষেবার এই পতন এবং অপুষ্টির দ্বিমুখী আঘাতের ফলেই শিশুদের মৃত্যুর হার উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মানবিক হস্তক্ষেপের জরুরি প্রয়োজন

সুদানের মধ্যাঞ্চলে এক মাসের মধ্যে অপুষ্টিজনিত কারণে ২৩ শিশুর মৃত্যু দেশটির চলমান গৃহযুদ্ধের মারাত্মক মানবিক প্রভাবের একটি স্পষ্ট উদাহরণ। সামরিক বাহিনী এবং আরএসএফ-এর মধ্যে ক্ষমতার লড়াই লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে এবং দেশের কিছু অংশকে দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবিলম্বে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে মানবিক সাহায্য পৌঁছানোর জন্য জরুরি হস্তক্ষেপ করতে হবে এবং শিশুদের জীবন বাঁচাতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। নতুবা, সংঘাত বন্ধ না হলে এবং মানবিক করিডোর নিশ্চিত না হলে, এই সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও বহু গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এম আর এম – ২৩২৫,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button