কাতারের রাবাতে অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে নাটকীয়তার চূড়ান্ত উপহার দিল ব্রাজিল ও মরক্কো। শেষ মুহূর্তের দুর্দান্ত গোলে মরক্কোকে ২-১ ব্যবধানে হারিয়ে টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। অন্যদিকে সুইজারল্যান্ডকে হারিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছেছে পর্তুগাল। ফলে প্রতিযোগিতার বড় লড়াইয়ের অন্যতম আকর্ষণীয় ম্যাচে এবার মুখোমুখি হচ্ছে ব্রাজিল-পর্তুগাল।
এই দুই দল যুব ফুটবলে ঐতিহ্যবাহী প্রতিদ্বন্দ্বী। ব্রাজিলের সৃজনশীল ফুটবল আর পর্তুগালের সংগঠিত আক্রমণাত্মক শৈলী—দুইয়ের লড়াই সবসময়ই বিশেষ উত্তেজনা তৈরি করে। তাই সেমিফাইনাল ঘিরে এখনই বিশ্বজুড়ে ফুটবলভক্তদের আগ্রহ তুঙ্গে।
মরক্কোর স্বপ্ন ভাঙল যোগ করা সময়ে
রাবাতের স্টেডিয়ামে শুরু থেকেই ব্রাজিল দাপট দেখাতে থাকে। প্রতিপক্ষের রক্ষণ ভেঙে ১৬ মিনিটেই গোল করেন ফরোয়ার্ড ডেল। শুরুতেই গোল পেয়ে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ আরও দৃঢ় করে ব্রাজিল। দ্রুত পাসিং, উইং ব্যবহার এবং বক্সে ধারাবাহিক চাপ—সব মিলিয়ে আফ্রিকান শক্তি মরক্কো শুরুতে কিছুটা পিছিয়ে পড়ে।
তবে ধীরে ধীরে নিজেদের ছন্দে ফেরে মরক্কোর দুর্দান্ত যুব দল। এ বছর আফ্রিকার অনূর্ধ্ব-১৭ চ্যাম্পিয়নশিপে নজরকাড়া পারফরম্যান্স দেখানো মরক্কো আবারো সেই দৃঢ়তা দেখায়। প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার ঠিক মুহূর্তে ব্রাজিল ডি-বক্সে ফাউল করলে পেনাল্টি পায় মরক্কো। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জিয়েদ বাহা গোল করে সমতা ফেরান।
১-১ ব্যবধানে বিরতিতে যাওয়ার পর দ্বিতীয়ার্ধ হয়ে ওঠে উত্তেজনার লড়াই। মরক্কো রক্ষণভাগ আরও শক্ত করে এবং ব্রাজিলের আক্রমণ ঠেকাতে কৌশলগত পরিবর্তন আনে। ব্রাজিল সুযোগ তৈরি করলেও মরক্কোর গোলরক্ষক ও রক্ষণভাগ দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়।
ম্যাচ যখন ধীরে ধীরে টাইব্রেকারের দিকে এগোচ্ছিল, তখনই যোগ করা সময়ের ৯৫ মিনিটে আবারও জাল খুঁজে পান ডেল। তাঁর ডানপায়ের শট প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের অতিক্রম করে পোস্টে লাগে হাল্কা প্রতিফলনে। গোল হতেই ব্রাজিল শিবিরে আনন্দের বিস্ফোরণ। অথচ মরক্কো খেলোয়াড়দের জন্য সেটিই ছিল বেদনার মুহূর্ত— ইতিহাসের প্রথম অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের স্বপ্ন সেখানেই শেষ হয়।
পর্তুগালের সহজ জয়, আত্মবিশ্বাসে টইটম্বুর দল
অন্য কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগাল তুলনামূলক সহজ লড়াইয়ে ২-০ ব্যবধানে হারিয়েছে সুইজারল্যান্ডকে। ম্যাচের ৪১ ও ৫৩ মিনিটে তারা গোল করে জয় নিশ্চিত করে। পর্তুগালের আক্রমণভাগে পুরো ম্যাচ জুড়েই ছিল শৃঙ্খল, ধারাবাহিকতা ও দক্ষতা। এই দলটি গ্রুপ পর্বেও দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়েছে এবং নকআউট পর্বেও সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে।
পর্তুগাল অনূর্ধ্ব-১৭ দল সাধারণত প্রযুক্তিগত দক্ষতা, দ্রুত পাসিং ও সংগঠিত রক্ষণ—এই তিন গুণে আলাদা পরিচিতি তৈরি করেছে। বর্তমান কোচিং স্টাফও তরুণ ফুটবলারদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন, যা মাঠে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ব্রাজিল বনাম পর্তুগাল: ফুটবলের দুই ধারার মহারণ
সেমিফাইনালে ব্রাজিল ও পর্তুগাল মুখোমুখি হওয়া মানেই প্রতিভার লড়াই। একদিকে ব্রাজিলের স্বতঃস্ফূর্ত, সৃজনশীল ও ছন্দময় আক্রমণ। অন্যদিকে পর্তুগালের স্থিরতা, কৌশলগত শৃঙ্খলা এবং দ্রুত কাউন্টার অ্যাটাক। এই দুই ভিন্ন ফুটবল দর্শনের সংঘর্ষ সবসময়ই অনিশ্চয়তার জন্ম দেয়—এমনটাই ফুটবল বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
ব্রাজিলের শক্তি
- উইঙ্গারদের গতি
- মাঝমাঠে সৃজনশীলতা
- ডেলকে কেন্দ্র করে আক্রমণের ধারাবাহিকতা
- পাঁচবারের বিশ্বকাপজয়ী দেশের যুব দলের আত্মবিশ্বাস
পর্তুগালের শক্তি
- শক্ত রক্ষণ
- দ্রুতগতির নির্মাণ ও সতর্ক আক্রমণ
- টেকনিক্যাল স্কিল
- চাপের মুহূর্তে স্থিরতা
ফিফা অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে এর আগে এই দুই দল বেশ কয়েকবার মুখোমুখি হয়েছে। ইতিহাস বলছে, ব্রাজিল কিছুটা এগিয়ে থাকলেও পর্তুগালের যুব দল কখনোই সহজ প্রতিপক্ষ নয়।
টুর্নামেন্টে ব্রাজিলের পথচলা
গ্রুপ পর্ব থেকেই ব্রাজিল দেখিয়েছে চ্যাম্পিয়নদের মতো ফুটবল।
- গ্রুপে বড় ব্যবধানে জয়
- দ্বিতীয় ম্যাচে কৌশলগত ফুটবল
- নকআউটে মরক্কোর বিপক্ষে শেষ মুহূর্তের নাটকীয়তা
বিশেষ করে ব্রাজিলের কোচ প্রতিটি ম্যাচে নতুন কৌশল প্রয়োগ করেছেন। সৃজনশীল ফুটবলে তারা বরাবরই শক্তিশালী, কিন্তু এবার রক্ষণভাগও অনেক বেশি শৃঙ্খলিত।
পর্তুগালের পথচলা
পর্তুগালের যাত্রাও সমান শক্তিশালী।
- গ্রুপ পর্বে রক্ষণে দৃঢ়তা
- সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে নিয়ন্ত্রিত জয়
- আক্রমণভাগে ধারাবাহিক গোল
দলটি বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা শুধু প্রতিভার ওপর নির্ভর করছে না—বরং দলীয় কৌশলই তাদের বড় শক্তি।
সেমিফাইনাল কবে, কখন, কোথায়
- ম্যাচ: ব্রাজিল বনাম পর্তুগাল
- প্রতিযোগিতা: ফিফা অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল
- তারিখ: আগামী সোমবার
- সময়: বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা
- ভেন্যু: কাতার, রাবাত
আরেক সেমিফাইনালে মুখোমুখি হচ্ছে ইতালি ও অস্ট্রিয়া।
সম্ভাব্য দুই দলের খেলোয়াড় তালিকা (অনুমান)
ব্রাজিল
- ডেল
- লুইজ
- রদ্রিগো
- হেনরিক
- রাফায়েল
- ব্রুনো
পর্তুগাল
- সিলভা
- মার্টিন্স
- ডান্তে
- রুবেন
- লোপেজ
- দোয়ার্তে
(ফিফার চূড়ান্ত স্কোয়াড ঘোষণা অনুযায়ী পরিবর্তন হতে পারে।)
কে এগিয়ে—ব্রাজিল না পর্তুগাল
অনেকেই ধারণা করছেন, বর্তমান ফর্ম অনুযায়ী ব্রাজিল এগিয়ে থাকবে। তারা বেশি আক্রমণাত্মক, ফিনিশিং শক্তিশালী এবং সেমিফাইনাল পর্যন্ত তাদের পারফরম্যান্স ধারাবাহিক। কিন্তু পর্তুগাল স্বভাবগতভাবেই বিপজ্জনক দল। তারা প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলে নয়, বরং ধীরে ধীরে ম্যাচ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়।
যে দল ছোট ছোট ভুল কম করবে, যে দল মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে—সেই দলই এগিয়ে থাকবে ফাইনালে যাওয়ার দৌড়ে।
ফাইনালকে সামনে রেখে উত্তেজনা বাড়ছে
মরক্কোকে হারিয়ে ব্রাজিল তাদের চ্যাম্পিয়ন প্রতিরক্ষা আরও শক্ত করল। অন্যদিকে পর্তুগালের সহজ জয়ও তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। দুই দলের সামগ্রিক শক্তিমত্তা দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় ম্যাচ হতে যাচ্ছে ব্রাজিল বনাম পর্তুগাল সেমিফাইনাল।
বিশ্ব ফুটবলের ভবিষ্যৎ তারকারা কারা—তাও অনেকটাই স্পষ্ট হবে এই ম্যাচে।
সোমবার রাতের লড়াই তাই শুধু একটি সেমিফাইনাল নয়; এটি আগামী দিনের বিশ্ব ফুটবলের এক রোমাঞ্চকর ঝলক।
MAH – 13926 I Signalbd.com



