ট্রাম্পের ২৮ দফা শান্তি পরিকল্পনা ইউক্রেন যুদ্ধের সমাধানের ভিত্তি হতে পারে: পুতিন
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২৮ দফা শান্তি পরিকল্পনা সংঘাতের একটি চূড়ান্ত মীমাংসার ভিত্তি স্থাপন করতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। শুক্রবার (২১ নভেম্বর) রুশ নিরাপত্তা পরিষদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এক সভায় তিনি এই পরিকল্পনার খসড়া হাতে পাওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেন। তবে একই সঙ্গে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, কিয়েভ যদি এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে, তবে রুশ বাহিনী ইউক্রেনে আরও অগ্রসর হবে এবং সংঘাত অব্যাহত থাকবে।
পুতিনের বক্তব্য: শান্তির ভিত্তি ও কিয়েভের প্রত্যাখ্যান
রুশ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে প্রেসিডেন্ট পুতিন জোর দিয়ে বলেন, ট্রাম্পের ২৮ দফা পরিকল্পনা ইউক্রেন সংকটের একটি ন্যায্য সমাধানের জন্য কার্যকর পথ হতে পারে। তিনি বলেন, “আমি বিশ্বাস করি এটি একটি চূড়ান্ত মীমাংসার ভিত্তি স্থাপন করতে পারে।” তবে তিনি এটাও স্পষ্ট করেন যে, এই শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এখনো বিস্তারিত আলোচনা হয়নি।
পুতিন কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ইউক্রেন প্রথম থেকেই এই পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। তিনি কিয়েভ এবং ইউরোপীয় শক্তিগুলোর প্রতি বাস্তবতা অনুধাবন করার আহ্বান জানান। পুতিন বলেন, “কিয়েভ বা ইউরোপীয় শক্তি কেউই এই বাস্তবতা বুঝতে পারেনি যে রুশ বাহিনী ইউক্রেনে অগ্রসর হচ্ছে এবং শান্তি না হলে এই অগ্রগতি অব্যাহত থাকবে।” অর্থাৎ, তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, শান্তি আলোচনা না হলে সামরিক পদক্ষেপ থামবে না।
মার্কিন প্রস্তাবের খসড়া: আপস ও শর্ত
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ট্রাম্পের ২৮ দফা শান্তি পরিকল্পনাটি ইউক্রেন বা এর ইউরোপীয় মিত্রদের ছাড়াই মার্কিন ও রুশ কর্মকর্তারা গোপনে প্রস্তুত করেছেন। বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) মার্কিন সেনাসচিব ড্যানিয়েল ড্রিসকল ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির কাছে লিখিত পরিকল্পনাটি পৌঁছে দেন।
জানা গেছে, এই পরিকল্পনায় বেশ কিছু কঠোর শর্ত রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে: ইউক্রেনকে কিছু অঞ্চল ছেড়ে দেওয়া, সামরিক বাহিনীর সংখ্যা ও অস্ত্রের পরিমাণ কমানোর বিষয় মেনে নেওয়া এবং ন্যাটোতে যোগদানের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করা। রয়টার্সের দেখা খসড়া অনুসারে, এতে এমন কিছু প্রস্তাবও রয়েছে যা মস্কোর জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে, যেমন মস্কোকে তাদের দখল করা কিছু এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। মূলত এটি দুই পক্ষের জন্যই কিছু ছাড় দেওয়ার একটি আপস প্রস্তাব।
জেলেনস্কির প্রতিক্রিয়া: মর্যাদা হারানোর শঙ্কা
মার্কিন শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি গভীর উদ্বেগ ও সতর্কতা প্রকাশ করেছেন। শুক্রবার দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে তিনি সতর্ক করেন যে, হোয়াইট হাউসের এই পরিকল্পনার কারণে ইউক্রেন তার মর্যাদা ও স্বাধীনতা অথবা ওয়াশিংটনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন হারাতে পারে।
জেলেনস্কি বলেন, ইউক্রেন এখন “খুব কঠিন এক অবস্থায়” রয়েছে। যেখানে তাদের হয় মর্যাদা হারানোর ঝুঁকি নিতে হবে, নয়তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী দেশটিকে হারানোর ভয় আছে। তিনি এই সময়টিকে “আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময়গুলোর একটি” হিসেবে উল্লেখ করেন এবং ইউক্রেনীয়দের প্রতি ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, তিনি কখনোই ইউক্রেনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না। অতীতেও জেলেনস্কি এই পরিকল্পনার শর্তাবলিকে ‘আত্মসমর্পণ’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
ট্রাম্পের সময়সীমা ও চাপ প্রয়োগ
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই পরিকল্পনা দ্রুত মেনে নেওয়ার জন্য কিয়েভের ওপর কঠোর সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। ফক্স নিউজ রেডিওকে তিনি জানিয়েছেন, কিয়েভকে আগামী বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) পর্যন্ত এই পরিকল্পনা মেনে নেওয়ার জন্য সময় দেওয়া হয়েছে, যা তাঁর মতে একটি উপযুক্ত সময়সীমা।
পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প রক্তপাত বন্ধের জরুরি প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, “শীতকাল ঘনিয়ে এসেছে। রক্তপাত বন্ধ করার জন্য সময় খুব কম। তাই জেলেনস্কিকে এই পরিকল্পনা অনুমোদন করতেই হবে।” ট্রাম্প আরও বলেন, “তাঁকে (জেলেনস্কি) এটা পছন্দ করতেই হবে। আর তাঁর পছন্দ না হলে আমার মনে হয়, তাদের লড়াই চালিয়ে যাওয়া উচিত।” ট্রাম্পের এই বক্তব্যে কিয়েভের ওপর চাপের মাত্রা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
অলীক কল্পনা না বাস্তব পথ?
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এই পরিকল্পনা প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ শেষ করার যেকোনো পরিকল্পনায় ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা উচিত এবং এটি উভয় দেশের কাছেই গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত। তবে ভ্যান্সের মতে, ইউক্রেন যদি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও অর্থ বা অস্ত্র পায় বা মস্কোর ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তবে ইউক্রেন জিততে পারবে—এটা ভাবা একটি ‘অলীক কল্পনা’।
তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’-এ (সাবেক টুইটার) লিখেছেন, “আমরা যদি আরও বেশি অর্থ, আরও বেশি অস্ত্র বা আরও বেশি নিষেধাজ্ঞা দিই, তবে জয় ইউক্রেনের হাতের মুঠোয় চলে আসবে, এটা একটা অলীক কল্পনা।” বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মন্তব্য আসলে বাস্তবতার নিরিখে আপস ও আলোচনার প্রয়োজনীয়তাকেই তুলে ধরে।
“ইউক্রেন এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু কিয়েভ বা ইউরোপীয় শক্তি কেউই এই বাস্তবতা বুঝতে পারেনি যে রুশ বাহিনী ইউক্রেনে অগ্রসর হচ্ছে এবং শান্তি না হলে তা অব্যাহত থাকবে।”—ভ্লাদিমির পুতিন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও দ্রুত সিদ্ধান্তের অপেক্ষা
ট্রাম্পের ২৮ দফা শান্তি পরিকল্পনা ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে একটি নতুন কূটনৈতিক জানালা খুলে দিয়েছে, কিন্তু এর শর্তগুলো উভয় পক্ষের জন্যই অত্যন্ত কঠিন। পুতিনের ইতিবাচক মনোভাব একদিকে যেমন আলোচনার আশা জাগাচ্ছে, অন্যদিকে জেলেনস্কির কঠোর বিরোধিতা ও মর্যাদা হারানোর শঙ্কা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। ট্রাম্পের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা পরিস্থিতিকে আরও নাটকীয় করে তুলেছে। বিশ্বজুড়ে বিশ্লেষকরা এখন কিয়েভের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন, কারণ ইউক্রেন এই প্রস্তাবে রাজি হবে কি না, তার ওপরই নির্ভর করছে আগামী দিনে যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতিপথ।
এম আর এম – ২৩২৩,Signalbd.com



