বিশ্ব

গণমাধ্যমগুলোকে অবশ্যই ইসলামি নীতি অনুযায়ী পরিচালিত হতে হবে: আফগানিস্তান

Advertisement

আফগানিস্তানের ইমারাতে ইসলামিয়ার তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে দেশের সব গণমাধ্যমকে ইসলামি নীতি, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও সরকারি নির্দেশনার আলোকে পরিচালিত হতে হবে। সরকার মনে করে, গণমাধ্যম রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলেও সেটিকে নির্দিষ্ট নৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর মধ্যেই কাজ করতে হবে।

বিশ্ব টেলিভিশন দিবসকে কেন্দ্র করে শুক্রবার (২১ নভেম্বর) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র খোবাইব গুফরান এসব বক্তব্য তুলে ধরেন।

ইসলামি নীতি মেনে পরিচালিত গণমাধ্যমই সহায়তা পাবে: তথ্য মন্ত্রণালয়

খোবাইব গুফরান বলেন,
“দেশের গণমাধ্যমগুলো সরকারি নীতি, ইসলামি মূল্যবোধ এবং আফগান সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সংবাদ পরিবেশন করলে তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তাদের সর্বাত্মক সহায়তা দেবে। গণমাধ্যম সমাজের দর্পণ, তাই তাদের দায়িত্বও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

তিনি আরও জানান, গত চার বছরে সরকার ১৮০টি গণমাধ্যম ও গণমাধ্যম–সহায়ক প্রতিষ্ঠানকে আনুষ্ঠানিক লাইসেন্স প্রদান করেছে। এসব লাইসেন্সের মাধ্যমে কার্যক্রমকে আনুষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা, সাংবাদিকদের সুরক্ষা এবং মানসম্মত সংবাদ পরিবেশন নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে।

তার তথ্যমতে, বর্তমানে আফগানিস্তানে টেলিভিশন, রেডিও, প্রিন্ট ও অনলাইনভিত্তিক মিলিয়ে প্রায় ৫০০টি গণমাধ্যম সক্রিয়।

বিশ্ব টেলিভিশন দিবস: গণমাধ্যমের গুরুত্ব নতুন করে স্মরণ

২১ নভেম্বর বিশ্ব টেলিভিশন দিবস। জাতিসংঘ ঘোষিত এই দিবস গণমাধ্যমের সমাজগঠন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং বিশ্ব ঘটনাবলির সঙ্গে মানুষের সংযোগ স্থাপনে টেলিভিশনের গুরুত্ব তুলে ধরে।

এদিনের বক্তব্যে খোবাইব গুফরান বলেন,
“টেলিভিশন কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি জাতির চিন্তা-চেতনা গড়ে তোলার অন্যতম শক্তিশালী উপাদান। তাই টেলিভিশনে প্রচারিত সবকিছুই হতে হবে দায়িত্বশীল ও নৈতিক।”

আফগানিস্তানে টিভি চ্যানেলের সংখ্যা বেড়েছে, কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি পাচ্ছে

আফগানিস্তান জার্নালিস্টস ইউনিয়নের প্রধান হুজ্জাতুল্লাহ মুজাদ্দেদি জানান, বর্তমানে দেশে ৮১টি টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচার করছে। এর মধ্যে ৫৬টি বেসরকারি এবং ২৫টি রাষ্ট্রীয় চ্যানেল। এসব চ্যানেলে প্রায় ১,৩৫৬ জন কর্মী কাজ করছেন।

হুজ্জাতুল্লাহ মুজাদ্দেদির মতে,
“গণমাধ্যম খাত দেশের অর্থনীতি, জনমত গঠন এবং সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও টেলিভিশন খাত এখনও কর্মসংস্থান তৈরির বড় একটি ক্ষেত্র।”

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ: আফগান গণমাধ্যমের সামনে সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ

আফগানিস্তানের গণমাধ্যম খাত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তালেবান সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পর্যবেক্ষণে বলা হয়,

  • সংবাদ পরিবেশনে সেন্সরশিপ বৃদ্ধি,
  • নারী সাংবাদিকদের কর্মক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা,
  • রাজনৈতিক সমালোচনার সুযোগ কমে যাওয়া,
  • বিদেশি সংবাদমাধ্যমের কার্যক্রম কমে যাওয়া
    —এসব কারণে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আগের তুলনায় সংকুচিত হয়েছে।

অনেক সংবাদ পাঠক মনে করেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নৈতিক নীতি—দুটিকে সমন্বয় করেই একটি টেকসই গণমাধ্যম কাঠামো গড়ে তোলা উচিত।

সাংবাদিকদের মত: সঠিক তথ্যপ্রবাহ জনআস্থা বাড়ায়

দেশের অনেক সাংবাদিকের মতে, সংবাদ প্রচারের মূল আকর্ষণ হচ্ছে মানুষের কাছে দ্রুত, নির্ভুল ও প্রমাণভিত্তিক তথ্য পৌঁছে দেওয়া। একজন সাংবাদিক বলেন,
“জনগণ আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে সত্য জানার জন্য। তাই সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা থাকা জরুরি। সঠিক তথ্যপ্রাপ্তি সহজ করলে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা আরও বাড়বে।”

আরেকজন গণমাধ্যমকর্মী মনে করেন,
“তথ্যের অবাধ প্রবাহ মানুষের চিন্তাশক্তিকে উন্মুক্ত করে, সমাজকে সচেতন করে এবং উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। তাই গণমাধ্যমের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা জরুরি।”

সরকারের যুক্তি: ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব

সরকারি সূত্র বলছে, আফগানিস্তানে ইসলামি ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই গণমাধ্যমে এমন কোনো কনটেন্ট প্রচার করা যাবে না, যা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বা ধর্মীয় বিধানের বিরোধিতা করে।

তাদের মতে,

  • পর্নোগ্রাফি,
  • বিভ্রান্তিকর প্রচার,
  • সহিংসতা উসকে দেওয়া,
  • রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড,
  • মিথ্যা সংবাদ
    —এসব বিষয় প্রতিহত করতে কিছু নিয়ন্ত্রণ জরুরি।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের মতে,
“স্বাধীনতা মানেই অবাধে সবকিছু প্রচার নয়। এরও একটি নৈতিক সীমানা আছে।”

তথ্যপ্রাপ্তির স্বাধিকার চাই: নাগরিকদের দাবি

তবে সাধারণ নাগরিক এবং অনেক গবেষক মনে করেন, তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ যত সহজ হবে, দুর্নীতি কমবে এবং রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে।

বেশ কয়েকজন দর্শক বলেন,
“টেলিভিশন হচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী। সংবাদে বৈচিত্র্য, বিশ্লেষণ এবং বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে চাই। মিডিয়াকে সৃজনশীলতার সুযোগ দিলে দেশ এগোবে।”

বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন: ব্যালান্সড মিডিয়া নীতি প্রয়োজন

আফগানিস্তানভিত্তিক গণমাধ্যম গবেষকরা মনে করেন, একটি ব্যালান্সড মিডিয়া পলিসি প্রয়োজন—যেখানে থাকবে

  • নৈতিক সাংবাদিকতা,
  • জনস্বার্থ রক্ষা,
  • তথ্যপ্রাপ্তির স্বাধীনতা,
  • রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা,
  • নিরাপদ কর্মপরিবেশ।

তাদের মতে,
“মিডিয়া যত শক্তিশালী হবে, রাষ্ট্র তত স্বচ্ছ হবে।”

মহিলা সাংবাদিকদের পরিস্থিতি

আন্তর্জাতিক গণসংস্থা ও আফগান নারীবিষয়ক অধিকারকর্মীরা উল্লেখ করেছেন যে বর্তমানে নারী সাংবাদিকদের জন্য দেশের গণমাধ্যম পরিবেশ আগের তুলনায় চ্যালেঞ্জিং।
অনেকে বাধ্য হয়েছেন অন্য পেশায় যেতে, অনেকেই অনলাইনে সীমিতভাবে কাজ করছেন।

তবে সরকার বলছে,
“যেসব নারী ইসলামি নীতি মেনে কাজ করতে চান, তাদের কাজের সুযোগ রয়েছে।”

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বনাম নৈতিক সীমা: ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা

আফগানিস্তানের বর্তমান বাস্তবতায় গণমাধ্যমের সামনে দুই ধরনের পথ:

  • একদিকে নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষা,
  • অন্যদিকে স্বাধীন ও মুক্ত সংবাদ পরিবেশনা।

এই দুটি দিকের সমন্বয় ঘটাতে হলে সরকারের দায়িত্বশীলতা, সাংবাদিকদের পেশাগত নৈতিকতা এবং জনগণের সচেতনতা—সবকিছুকেই একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

আফগানিস্তানের গণমাধ্যম খাত এখন এক নতুন পর্যায়ে দাঁড়িয়ে। সরকারের লক্ষ্য ইসলামি নীতি ও সামাজিক মূল্যবোধ রক্ষা; অন্যদিকে সাংবাদিক ও নাগরিকদের প্রত্যাশা তথ্যপ্রাপ্তির স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা।

বিশ্ব টেলিভিশন দিবসে এই আলোচনা আরও স্পষ্ট করে তুলেছে যে দেশটির গণমাধ্যম—টেলিভিশনসহ সব প্ল্যাটফর্ম—সমাজকে প্রভাবিত করতে পারে বিশালভাবে। তাই একটি ভারসাম্যপূর্ণ গণমাধ্যম কাঠামো গঠনই হতে পারে ভবিষ্যৎ আফগানিস্তানের প্রধান চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা।

MAH – 13925 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button