বিশ্ব

ফ্যাসিস্ট হাসিনার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে যা বললো পাকিস্তান

Advertisement

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড নিয়ে অবশেষে আনুষ্ঠানিক অবস্থান জানালো পাকিস্তান। ইসলামাবাদ জানিয়েছে, এ বিষয়টি সম্পূর্ণই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিচারিক প্রক্রিয়ার অংশ, এবং বাংলাদেশের জনগণ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিজেদের সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম।

শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সাপ্তাহিক নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তাহির আন্দরাবি এই মন্তব্য করেন। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ডনের প্রতিবেদন সহ আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলো পাকিস্তানের এই প্রতিক্রিয়াকে দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান বলে আখ্যা দিয়েছে।

পাকিস্তানের বক্তব্য: ‘বাংলাদেশের জনগণ তাদের সংকট নিজেরাই সমাধান করতে পারবে’

সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রশ্নোত্তর পর্বে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের জবাব দিতে গিয়ে তাহির আন্দরাবি বলেন:

“শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেওয়া রায় বাংলাদেশের আদালতের সিদ্ধান্ত। এটি সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের জনগণ নিজেদের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম।”

তিনি আরও বলেন, পাকিস্তান সবসময় প্রতিবেশী দেশগুলোর সার্বভৌম সিদ্ধান্তকে সম্মান করে। প্রতিটি দেশের নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা আছে, এবং সেসব প্রক্রিয়ার মধ্যে যে সিদ্ধান্তগুলো গৃহীত হয়, তা নিয়ে পাকিস্তানের সরাসরি মন্তব্য করার কোনো সুযোগ নেই।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই অবস্থান পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের নীতির প্রতিফলন বলেই আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত। তারা মনে করছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় বিরাজমান নাজুক কূটনৈতিক পরিবেশে পাকিস্তান কোনো ধরনের উত্তেজনা তৈরি করতে চাইছে না।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও শেখ হাসিনার মামলার পটভূমি

বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংঘাত ও বারবার ক্ষমতার পালাবদলের প্রেক্ষাপটে চলছে নানা ধরনের বিচারিক প্রক্রিয়া। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলাটি রাষ্ট্রপক্ষ দাবি করেছে—দেশের ইতিহাসে সংঘটিত গুরুতর অপরাধের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আদালতে তুলে ধরা হয়েছে।

তবে বিএনপি, গণবিশ্বস্ততা আন্দোলনসহ বহু রাজনৈতিক সংগঠন দাবি করছে—এই বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, আদালত স্বাধীনভাবে প্রমাণের ভিত্তিতে রায় দিয়েছে, এবং কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক পক্ষ রায়কে প্রভাবিত করতে পারেনি।

পাকিস্তান কেন এমন সতর্ক অবস্থান নিল? আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের বক্তব্য

আন্তর্জাতিক রাজনীতি পর্যবেক্ষকরা বলছেন, কয়েকটি কারণে পাকিস্তান এই ব্যাপারে নিরপেক্ষ ও সতর্ক অবস্থান নিয়েছে:

১. ঢাকা–ইসলামাবাদ সম্পর্ক আগেই নাজুক

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক বহু বছর ধরেই উত্তেজনা, বিরোধ ও অবিশ্বাসের মধ্য দিয়ে চলছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার ইস্যুতে পাকিস্তানের অতীত মন্তব্য দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি করেছিল।

২. দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা

ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র—সব দেশের মধ্যেই বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ভিন্ন ভিন্ন কৌশলগত অবস্থান ধরে রেখেছে। ফলে পাকিস্তান কোনো উত্তেজনাকর বক্তব্য দিয়ে ঝুঁকি নিতে চাইছে না।

৩. অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি

পাকিস্তান নিজ দেশেই রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাই বিদেশি কোনো ইস্যু নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করতে চায় না।

৪. কূটনৈতিক নিয়ম

পাকিস্তান বলেছে, তারা অন্য দেশের বিচারিক রায়ের ওপর সরাসরি মন্তব্য না করার নীতি অনুসরণ করছে।

বাংলাদেশ কী বলছে?

বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে তাত্ক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার মতে, পাকিস্তানের এ ধরনের অবস্থান নেয়া ঢাকার কূটনৈতিক স্বার্থেই ইতিবাচক।

একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন:

“কোনো দেশ যখন আমাদের অভ্যন্তরীণ বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে অকারণ মন্তব্য করে না, তা অবশ্যই ভালো। বাংলাদেশ তার নিজস্ব আইনি কাঠামো অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।”

আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিক্রিয়া: নীরবতা ও সতর্কতা

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পর বিশ্বের অনেক দেশই এখনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো অত্যন্ত সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে দেশগুলো এখন প্রতিটি বিবৃতিতে অত্যন্ত সতর্ক।

জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা (OHCHR) বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে কিছু উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তারা বলেছে—চূড়ান্তভাবে প্রতিটি দেশের নিজস্ব বিচার ব্যবস্থাকে সম্মান করা উচিত।

মৃত্যুদণ্ড রায় নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ

বাংলাদেশে এই রায় ঘোষণার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। একদিকে সরকারপন্থী অংশ রায়কে স্বাগত জানালেও বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। রায়ের দিনের পর থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

বিচার বিশ্লেষকরা বলছেন, এই রায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন সংলাপ, নতুন সমীকরণ ও সম্ভাব্য সংঘাতের সূচনা করতেও পারে।

পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়ার তাৎপর্য কী?

পাকিস্তানের এই অবস্থান কূটনৈতিকভাবে তিনটি বার্তা দেয়:

১. ঢাকা–ইসলামাবাদ সম্পর্ককে উত্তপ্ত করতে রাজি নয়

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপ না করে পাকিস্তান এখন একটি কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে চাইছে।

২. আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের নিরপেক্ষ দেখানোর চেষ্টা

বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে পাকিস্তান এখন আগের মতো সরাসরি আগ্রাসী মন্তব্য না করে নরম কূটনীতি অনুসরণ করছে।

৩. আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার বার্তা

এমন মন্তব্যের মাধ্যমে পাকিস্তান জানিয়ে দিল—তারা বর্তমান আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি করতে চায় না।

ভবিষ্যতে দুই দেশের সম্পর্ক কোন দিকে যাবে?

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য, ভিসা নীতি, কূটনৈতিক সংযোগসহ বেশ কিছু বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে অগ্রগতি হয়নি। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, দুই দেশই চাইলে সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ আছে, কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ইতিহাসের কারণে এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি ধীরগতিতে এগোয়।

পাকিস্তানের এই নিরপেক্ষ প্রতিক্রিয়া হয়তো ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক আলোচনার জন্য কিছুটা ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে, যদিও বাস্তবে তা ঘটবে কি না—তা নির্ভর করছে দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর।

সংক্ষেপে

– পাকিস্তান বলেছে, শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড সম্পূর্ণই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
– আদালতের সিদ্ধান্ত নিয়ে ইসলামাবাদ কোনো মন্তব্য করতে রাজি নয়।
– দুই দেশের সম্পর্ক যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়—সেই বিবেচনায় পাকিস্তান সতর্ক কূটনৈতিক অবস্থান নিয়েছে।
– আন্তর্জাতিক বিশ্বও বিষয়টি নিয়ে আপাতত নীরব বা সতর্ক
– বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এ রায় নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক, উদ্বেগ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে।

MAH – 13924 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button