শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রাজধানী ঢাকার অদূরে নরসিংদীর মাধবদী উপজেলায় এই ভূমিকম্পের উৎপত্তি হলেও প্রভাব বিস্তৃতভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুভূত হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে হেলেছে অগণিত স্থাপনা ও ভবন, সৃষ্টি হয়েছে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আহত ও নিহতের সংখ্যা বেড়েছে।
ভূমিকম্পের ফলে সারাদেশে অন্তত ১০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এছাড়া, আহত হয়েছেন ৫ শতাধিকের বেশি মানুষ। আহতদের মধ্যে অনেককে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সিলেটসহ বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমবেদনা
বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিদল ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ও তাদের পরিবারগুলোর প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশে নিযুক্ত তাদের ফেসবুক পেজে লিখেছে, “আমরা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে আছি এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। আমরা সরকারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে প্রয়োজনে সাহায্যের প্রস্তুতি নিয়েছি।”
ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই সমবেদনা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সংহতি ও মানবিক সহায়তার গুরুত্বকে সামনে রেখে। বিশেষ করে বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক দুর্যোগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভূমিকম্পের বিস্তার ও প্রভাব
ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদী জেলার মাধবদী উপজেলা। ভূমিকম্পের তীব্রতা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো শহর ও উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অনুভূত হয়। মাত্র কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হলেও এর প্রভাব স্থায়ী ক্ষতি এবং মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
ভূমিকম্পের সময় অনেক মানুষ নিজেদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়। স্কুল, কলেজ, অফিস, মসজিদসহ বিভিন্ন স্থানে থাকা মানুষ দ্রুত বাইরে বের হতে চেষ্টা করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ ধরনের ভূমিকম্প হঠাৎ ঘটে এবং খুব কম সময়ের মধ্যে মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া যায় না, তাই আতঙ্কিত হওয়ার ঘটনা স্বাভাবিক।
ক্ষয়ক্ষতি ও আহতের পরিস্থিতি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার রাত ৮টা পর্যন্ত দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে সাড়ে চার শতাধিক আহত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৬৭ জনকে ভর্তি করা হয়েছে এবং গুরুতর আহত ১৬ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্যান্য হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে।
ভূমিকম্পে হেলে পড়েছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ভবন। অনেকের ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকার পুরনো ও দোতলা ভবনগুলোতে প্রভাব বেশি পড়েছে। কিছু এলাকায় রাস্তা ও পাকা সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিদ্যুৎ ও টেলিফোন সেবা প্রায় এক ঘণ্টার জন্য বন্ধ থাকার খবর পাওয়া গেছে।
উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম
বাংলাদেশের সরকার দ্রুত ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেছে। বিভিন্ন জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধার এবং প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য মাঠে উপস্থিত হয়েছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা দ্রুত উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন।
সরকারি পক্ষ থেকে জরুরি ভিত্তিতে মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রয়োজনীয় ঔষধ ও সরঞ্জাম সহ উদ্ধারকাজে স্থানীয় জনগণও অংশগ্রহণ করছে। আহতদের তাত্ক্ষণিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও অন্যান্য শহরের বড় হাসপাতালগুলোতে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প যথেষ্ট বিপজ্জনক। “যদি ভবনের নকশা এবং নির্মাণ মান ঠিকভাবে অনুসরণ করা না হয়, তবে তীব্র প্রভাব বেশি হয়। তাই নতুন ভবনগুলোর ক্ষেত্রে সঠিক সিসিম্যান্ট এবং শক্তপোক্ত নকশা অনুসরণ জরুরি,”– মন্তব্য করেছেন ভূতত্ত্ববিদরা।
আন্তর্জাতিক সহায়তা ও সমর্থন
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়াও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা অবিলম্বে ত্রাণ কার্যক্রমে সহযোগিতা এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্যোগে আন্তর্জাতিক সহায়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ তা প্রাথমিক সাহায্য, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া
ঢাকার ও নিকটবর্তী এলাকার মানুষ ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কিত হয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে বের হয়েছেন। বাজার, রাস্তা ও অফিসে কাজ করা মানুষ হঠাৎ রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। অনেক মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে খবর ভাগাভাগি করেছেন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের চোটাক্রমে অনেক বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু বড় ধরনের ধ্বংস হয়নি।
ভবিষ্যতের প্রস্তুতি
ভূমিকম্পের এই ঘটনায় বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, বাংলাদেশে পরবর্তীতে আরও শক্তিশালী ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে ভবন ও রাস্তা নির্মাণে আরও কড়া নিয়মাবলী ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। স্থানীয় মানুষকেও ভূমিকম্পকালীন নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, যাতে এমন দুর্যোগের সময় কম ক্ষতি হয়।
সরকারের দায়িত্ব ও প্রস্তুতি
সরকার দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন ও আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে। মন্ত্রণালয়গুলো ও স্থানীয় প্রশাসন একত্রিত হয়ে আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ কার্যক্রম চালাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ডাক্তার, নার্স এবং জরুরি ওষুধ সরবরাহ করা হয়েছে।
সরকারি পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যারা নিজেরা নিরাপদে আছেন, তারা অন্যদের সাহায্যে এগিয়ে আসবেন। এছাড়া, নিরাপত্তা ও চিকিৎসা সংক্রান্ত সকল তথ্য জনগণের কাছে দ্রুত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ভূমিকম্পের এই দুর্যোগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমবেদনা ও সহায়তা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। সরকার, স্থানীয় প্রশাসন এবং সাধারণ মানুষ একসঙ্গে কাজ করে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য দ্রুত কার্যক্রম শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ভবিষ্যতে এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা থাকায় প্রস্তুতি অব্যাহত রাখতে হবে।
এই ভূমিকম্প আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকা ও নিরাপদ ভবনের গুরুত্ব অপরিসীম।
MAH – 13920 I Signalbd.com



