আবহাওয়া

ভূমিকম্পঝুঁকিপ্রবণ জেলা: সর্বোধিক আতঙ্ক ও প্রস্তুতি জরুরি

Advertisement

গতকাল এক শক্তিশালী ভূমিকম্পে বাংলাদেশে ভূমিকম্পঝুঁকিপ্রবণতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আবারো সামনে এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের বিভিন্ন জেলা ভূমিকম্পের সম্ভাব্যতা ও ঝুঁকি অনুযায়ী ভাগ করা হয়েছে তিনটি গুরুতর জোনে – জোন‑১ (উচ্চ ঝুঁকি), জোন‑২ (মধ্য ঝুঁকি) ও জোন‑৩ (নিম্ন ঝুঁকি)। এই প্রতিবেদনে আমরা বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করব, কোন জেলা গুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি রয়েছে, সেই ঝুঁকির কারণ কী এবং তৈরি থাকতে হলে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

ভূমিকম্প‑ঝুঁকি: বাংলাদেশে তিনটি সিজমিক জোন

বাংলাদেশে ভূমিকম্পঝুঁকি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ মানচিত্র প্রস্তুত করা হয়েছে যা বিশেষত বাংলাদেশের প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (BUET) এবং আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি। এই মানচিত্র অনুযায়ী, দেশকে তিনটি ভূমিকম্প‑ঝুঁকি জোনে ভাগ করা হয়েছে:

  • জোন‑১: সর্বোচ্চ ঝুঁকিপ্রবণ
  • জোন‑২: মধ্যম ঝুঁকিপ্রবণ
  • জোন‑3: তুলনামূলক কম ঝুঁকিপ্রবণ

এই বিভাজনের ভিত্তি গৃহীত হয়েছে ভূমিকম্প‑সাম্ভাব্যতা, ভূস্তর (গ্রাউন্ড অ্যাক্সিলারেশন), এবং অতীতের কম্পন ইতিহাসের উপর। উদাহরণস্বরূপ, আবহাওয়া অধিদপ্তরের জরিপ এবং ভূ-কম্পন সংশ্লিষ্ট গবেষণা দেখায়, জোন‑১-এর এলাকায় ফল্ট লাইন বা প্লেট বাউন্ডারির কাছাকাছি অঞ্চলগুলো ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সংবেদনশীল।

কোন জেলা গুলো ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে (জোন‑১)?

জোন‑১ বা উচ্চ ঝুঁকিপ্রবণ এলাকায় যে জেলার নাম সবচেয়ে বেশি উঠে আসে, সেগুলো হলো:

  • সিলেট বিভাগ: সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ
  • ময়মনসিংহ বিভাগ: ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর
  • উত্তরাঞ্চল: জামালপুর, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়
  • কিশোরগঞ্জ ও আশপাশের এলাকা: কিশোরগঞ্জ পুরোপুরি
  • ঢাকার আশপাশ: টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নরসিংদীর কিছু অংশ
  • পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু এলাকা: রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি

এই জেলা গুলো ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপ্রবণ। গবেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে এই এলাকায় আরও বড় কম্পন ঘটার সম্ভাবনা আছে।

মধ্যম ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা (জোন‑২)

জোন‑২-এ বেশ কয়েকটি জেলা রয়েছে, যেখানে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা কম হলেও সম্পূর্ণ নিরাপদ বলা যায় না। কিছু প্রধান জেলা হলো:

  • রাজশাহী বিভাগ: রাজশাহী, নাটোর, মাগুরা, মেহেরপুর
  • ঢাকা বিভাগের কিছু অংশ: ঢাকা শহর, নারায়ণগঞ্জ, মনিকগঞ্জ
  • কুমিল্লা বিভাগ: কুমিল্লা, ফেনি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কিছু অংশ

মধ্য ঝুঁকিপ্রবণ হওয়ায়, এখানে ভবন, অবকাঠামো এবং প্রস্তুতি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

কম ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা (জোন‑৩)

জোন‑৩-এ এমন জেলা রয়েছে যেখানে ভূমিকম্প সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে কম। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  • বরিশাল বিভাগ
  • পটুয়াখালী
  • খুলনা, যশোর
  • দেশীয় কিছু চর ও দ্বীপাঞ্চল

এই জেলার মানুষ তুলনামূলকভাবে নিরাপদ হলেও, অপ্রত্যাশিত কম্পনের জন্য প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন।

ঝুঁকির কারণ: ভূ-তান্ত্রিক উৎস

কিছু জেলা এত বেশি ঝুঁকিতে হওয়ার পেছনে রয়েছে একাধিক ভূ-তান্ত্রিক কারণ:

  1. ডাউকি ফল্ট: ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট এলাকায় অবস্থিত, যা ভূমিকম্পের মূল উৎস।
  2. মধুপুর ফল্ট: মধুপুর অঞ্চলে এই ফল্ট ভূমিকম্পের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে কাজ করে।
  3. ইন্দো–বার্মা প্লেট বাউন্ডারি: বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-উত্তর-পূর্বে সক্রিয় প্লেট সীমান্ত রয়েছে।
  4. ফল্ট লাইন ও ভূ-আকৃতি: সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ফল্ট লাইন এবং হিমালয়ান থ্রাস্ট বেল্ট ভূমিকম্পের সম্ভাব্য উৎস।

এই কারণেই সিলেট, ময়মনসিংহ, রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজার এলাকায় ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি।

অতীতের ভূকম্পন

গবেষণা ও পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে অতীতে বেশ কিছু শক্তিশালী ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে, বিশেষত জোন‑১ এলাকায়:

  • ১৯৭৬ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত অন্তত ৫টি শক্তিশালী ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে।
  • সিলেট, মৌলভীবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজারে কম্পন সর্বাধিক।
  • উত্তরের কিছু জেলা (গাইবান্ধা, বগুরা, নেট্রকোনা) বিভিন্ন ফল্ট লাইনের কারণে কম্পনের সংবেদনশীল।

সমস্যা ও ঝুঁকি: প্রস্তুতির অভাব

যদিও ঝুঁকি রয়েছে, বাংলাদেশের প্রস্তুতি ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা সব সময় পর্যাপ্ত নয়। বিশেষ কিছু চ্যালেঞ্জ হলো:

  • বিল্ডিং কোডের অপ্রয়োগ: অনেক ভবন এখনও বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুযায়ী তৈরি হচ্ছে না।
  • মানচিত্র ও তথ্যের অপর্যাপ্ত ব্যবহার: আধুনিক সিজমিক মানচিত্র ও তথ্যের ব্যবহার সব জায়গায় কার্যকর নয়।
  • অবচেতনতা: সাধারণ মানুষ ভূমিকম্প ঝুঁকি ও প্রস্তুতি সম্পর্কে সচেতন নয়।
  • দূর্গম অঞ্চলে অবকাঠামো দুর্বল: পার্বত্য ও সীমান্তবর্তী এলাকায় অবকাঠামোর মান কম, যা ঝুঁকি বাড়ায়।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, ভবিষ্যতে বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষত সিলেট-টেকনাফ সাবডাকশন জোনে। সম্ভাব্য মাত্রা ৭.৫ থেকে ৮.০ পর্যন্ত হতে পারে। প্রধান ভূকম্পনের উৎস হিসেবে উল্লেখযোগ্য:

  • ইন্দো-বার্মা সাবডাকশন জোন
  • ডাউকি ফল্ট
  • হিমালয়ান থ্রাস্ট বেল্ট

প্রস্তুতির পথ ও সুপারিশ

ঝুঁকিপ্রবণ জেলা এবং সাধারণ মানুষকে ভূমিকম্প মোকাবিলায় কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে হবে:

  1. বিল্ডিং কোড প্রয়োগ: উচ্চ ঝুঁকিপ্রবণ এলাকায় ভবন BNBC অনুযায়ী নির্মাণ করতে হবে।
  2. সচেতনতা বৃদ্ধি: স্কুল, কলেজ ও স্থানীয় কমিউনিটিতে প্রশিক্ষণ ও পুনরাবৃত্তি সেশন।
  3. ইনফ্রাস্ট্রাকচার মজবুতকরণ: হাসপাতাল, স্কুল, প্রশাসনিক ভবনকে ভূমিকম্প-প্রতিরোধী ডিজাইন করা।
  4. জোন ম্যাপ আপডেট: মানচিত্র নিয়মিত আপডেট ও আইনগত বাধ্যতামূলক করা।
  5. জরুরি প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা: প্রতিটি জেলা ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট টিম গঠন, ব্যাকআপ যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পুনরাবৃত্তিমূলক ব্যায়াম।
  6. ফল্ট-লাইন গবেষণা বৃদ্ধি: ভূ-তত্ত্ববিদদের সঙ্গে সমন্বয় বাড়িয়ে ফল্ট লাইন ও ভূমিকম্প উৎস পর্যবেক্ষণ।

ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কিন্তু প্রস্তুতি ও সচেতনতা থাকলে এর প্রভাব কমানো সম্ভব। বাংলাদেশের কিছু জেলা ইতিমধ্যেই উচ্চ ঝুঁকি জোনে রয়েছে। সাধারণ মানুষ, স্থানীয় প্রশাসন ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তুতি গ্রহণ করলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

বাংলাদেশে ভূমিকম্পঝুঁকি কেবল ভৌগোলিক বিষয় নয়, এটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক বিপদ ব্যবস্থাপনার মূল চ্যালেঞ্জ। তাই আজই সচেতন হওয়া এবং প্রস্তুতি নেওয়া সময়োপযোগী ও জরুরি।

MAH – 13913 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button