বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দর এক দিনে গেট পাস ইস্যুতে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। গত মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) বন্দরের বিভিন্ন টার্মিনাল, অফডক ও সংশ্লিষ্ট সেবা কেন্দ্র মিলিয়ে মোট ৬ হাজার ৩০১টি গেট পাস ইস্যু হয়। এটি চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসে এক দিনের সর্বোচ্চ গেট পাস ইস্যুর রেকর্ড বলে নিশ্চিত করেছেন বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক।
তিনি জানান, এর মধ্যে ৪ হাজার ৭৩৪টি কনসাইনি গেট পাস এবং ১ হাজার ৫৬৭টি অফডক গেট পাস ছিল। এই সংখ্যাটি বন্দরের কার্যক্রমে নতুন মাইলফলক হিসেবে উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব বহন করে।
চট্টগ্রাম বন্দর: দেশের বাণিজ্যের প্রধান প্রবেশদ্বার
দেশের মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় ৯২ শতাংশ কার্যক্রম সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। আমদানি-রপ্তানির প্রতিটি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক, কৃষিপণ্য, যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রনিকস, কাঁচামাল ও শিল্পপণ্য—সবকিছুই এই বন্দরের ওপর নির্ভর করে।
চট্টগ্রাম বন্দরের প্রতিদিনের কার্যক্রম যত দ্রুত ও কার্যকর হয়, দেশের অর্থনীতি তত গতি পায়। এ কারণেই বন্দরের প্রতিটি অগ্রগতি জাতীয় বাণিজ্যক্ষেত্রে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
এই প্রেক্ষাপটে এক দিনে ৬ হাজারের বেশি গেট পাস ইস্যু করা শুধু একটি নতুন পরিসংখ্যান নয়; এটি বাংলাদেশ বন্দর ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন ও দক্ষতার প্রমাণ।
ডিজিটালাইজেশনের সুফল: দ্রুত ও স্বচ্ছ গেট অপারেশন
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গেট পাস ইস্যুর নতুন এই রেকর্ড সম্ভব হয়েছে মূলত বন্দরের ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রম সম্প্রসারিত হওয়ায়। চট্টগ্রাম বন্দর কয়েক বছর ধরে প্রযুক্তিনির্ভর সেবাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
বিশেষ করে টার্মিনাল অপারেটিং সিস্টেম (TOS) ও ডিজিটাল গেট পাস অ্যাপ ব্যবস্থার কারণে গেট অপারেশন আগের তুলনায় বহুগুণ দ্রুত হয়েছে।
ডিজিটালাইজেশন যেসব পরিবর্তন এনেছে:
- গেট পাস আবেদন পুরোপুরি অনলাইন
- QR কোডের মাধ্যমে দ্রুত স্ক্যানিং
- কাগজপত্র যাচাইয়ের সময় কমে গেছে
- ব্যবসায়ীরা যেকোনো স্থান থেকে মোবাইল বা কম্পিউটার দিয়ে গেট পাস নিতে পারছেন
- রিয়েল-টাইম ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে কনটেইনার মুভমেন্ট নজরদারি
- ফি পরিশোধ ডিজিটাল পেমেন্টের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে
- বন্দরের নিরাপত্তা আরও শক্তিশালী হয়েছে
এর ফলে শুধু সেবার মানই বাড়েনি, ব্যবসায়ীদের সময় ও ব্যয় উভয়ই কমেছে।
বন্দরসচিব বলেন, আগের তুলনায় এখন গেট অপারেশন অনেক বেশি সুশৃঙ্খল। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের কারণে প্রতিটি কার্যক্রম রিয়েল-টাইমে মনিটর করা যায়। এটি বন্দরের সার্বিক কাজের গতি এবং স্বচ্ছতা বাড়িয়েছে।
কনসাইনি ও অফডক গেট পাস: রেকর্ডের পেছনে সমন্বিত ব্যবস্থা
চট্টগ্রাম বন্দরের গেট পাস দুই ধরনের:
১. কনসাইনি গেট পাস
এটি মূলত আমদানিকারকদের জন্য। জাহাজ থেকে নামানো কনটেইনার সরাসরি বিভিন্ন গুদাম বা কারখানায় নেওয়ার জন্য কনসাইনি পাস প্রয়োজন হয়।
১৮ নভেম্বর ইস্যু হয়েছে ৪,৭৩৪টি কনসাইনি পাস।
এত বেশি সংখ্যক পাস ইস্যু হওয়া আমদানি কার্যক্রমের গতি ও প্রবাহ বৃদ্ধির একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত।
২. অফডক গেট পাস
অফডক বা আইসিডি (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) থেকে কনটেইনার সরানোর জন্য প্রয়োজন হয় অফডক গেট পাস। দেশে রপ্তানি পণ্যের বড় অংশ অফডকে প্রস্তুত করা হয়।
১৮ নভেম্বর ইস্যু হয়েছে ১,৫৬৭টি অফডক গেট পাস।
এটি রপ্তানিমুখী শিল্প এবং রপ্তানি বাণিজ্যের গতিশীলতার ইতিবাচক প্রমাণ।
বন্দর উন্নয়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা
চট্টগ্রাম বন্দর গত কয়েক বছর ধরে বিপুল উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। এর ফলে বন্দরের সামগ্রিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নসমূহ:
১. নতুন টার্মিনাল নির্মাণ
- পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (PCT)
- বে-টার্মিনাল উন্নয়ন প্রকল্প
- নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের প্রসার
এসব টার্মিনাল চালু হলে বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা আরও কয়েক লাখ টিইইউ বৃদ্ধি পাবে।
২. আধুনিক স্ক্যানার
এক্সরে স্ক্যানার স্থাপনের ফলে কনটেইনার পরীক্ষা দ্রুত হয়েছে, নিরাপত্তা বেড়েছে এবং সময় কম লেগেছে।
৩. স্মার্ট গেট ও অটোমেশন
RFID ও QR স্ক্যানিং পদ্ধতি ব্যবস্থাকে আরও সহজ করেছে।
৪. অনলাইন ডেলিভারি অর্ডার (e-DO)
আগে যেখানে ক্লিয়ারিং এজেন্টদের একাধিক দপ্তরে যেতে হতো, এখন তা অনলাইনে করা যায়।
৫. বন্দর সড়ক ও রেল অবকাঠামো উন্নয়ন
বঙ্গবন্ধু টানেল, চার লেন করার কাজ, রেলপথ সম্প্রসারণ—সব মিলিয়ে পরিবহন ব্যবস্থা আরও দক্ষ হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব উন্নয়নই এক দিনে এত গেট পাস ইস্যু করতে সক্ষম করেছে।
ব্যবসায়ীদের মতামত: সময় সাশ্রয়ই বড় অর্জন
বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন বলছে, ডিজিটাল গেট পাস তাদের কাজকে ব্যাপকভাবে সহজ করেছে।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের এক সদস্য বলেন, গেট পাস নিতে আগে প্রচুর সময় নষ্ট হতো। এখন পুরো প্রক্রিয়া অনলাইন হওয়ায় ব্যবসা পরিচালনা অনেক সহজ হয়েছে।
এক আমদানিকারক জানান, গেট পাস দ্রুত পেলে কনটেইনার বন্দরে জমে থাকে না। ফলে ডেমারেজ বা বাড়তি চার্জের ঝুঁকি কমে গেছে।
রপ্তানিকারকেরা বলছেন, অফডকে পণ্য লোডিং—আনলোডিং এখন আরও দ্রুত হয়। এতে রপ্তানি সময়মতো সম্পন্ন করা সহজ হয়েছে।
চ্যালেঞ্জ এখনো আছে, তবে সমাধানের পথে
যদিও চট্টগ্রাম বন্দর অনেক দিক থেকে এগিয়েছে, তবুও কিছু অবিচ্ছিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলো হলো:
- সড়কে ট্রাক ও কনটেইনারের জট
- শহরের যানজট বন্দরের স্বাভাবিক কাজে প্রভাব ফেলে
- রেলপথে কনটেইনার পরিবহণ এখনো সীমিত
- কিছু সেবার ক্ষেত্রে মানবসম্পদের ঘাটতি
- কাস্টমস ও বন্দরের মধ্যে আরও সমন্বয় প্রয়োজন
তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিটি সমস্যার সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: পুরোপুরি স্মার্ট পোর্টের পথে চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ভবিষ্যতের জন্য কয়েকটি লক্ষ্য স্থির করেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- সম্পূর্ণ অটোমেশন-নির্ভর গেট অপারেশন
- পোর্ট ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার
- ব্লকচেইন-ভিত্তিক কার্গো নথি যাচাই ব্যবস্থা
- আরও সমন্বিত ডিজিটাল পোর্ট ইকোসিস্টেম
- বন্দরের ভেতর স্বয়ংক্রিয় যানবাহন ব্যবহারের প্রাথমিক পরীক্ষা
- কর্মীদের জন্য বিশেষ ডিজিটাল প্রশিক্ষণ কর্মসূচি
এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রাম বন্দর দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আধুনিক বন্দরে পরিণত হবে।
সার্বিক বিশ্লেষণ: রেকর্ডের পিছনে অগ্রগতির দীর্ঘ যাত্রা
চট্টগ্রাম বন্দরের এক দিনে ৬,৩০১ গেট পাস ইস্যুর রেকর্ড কেবল একটি পরিসংখ্যানিক অর্জন নয়। বরং এটি বাংলাদেশের বন্দরব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি উন্নতির প্রতিফলন।
এটি দেখায়—
- বন্দর এখন আগের তুলনায় দ্রুত
- ডিজিটাল সেবায় জনগণ আস্থা রাখছে
- ব্যবসায়ীদের কাজ সহজ হয়েছে
- রপ্তানিমুখী শিল্প আরও শক্তিশালী হচ্ছে
- প্রযুক্তিনির্ভর সেবা জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে
বন্দরসচিবের ভাষায়, এই সাফল্য প্রমাণ করে চট্টগ্রাম বন্দর সঠিক দিকেই এগোচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরও বড় অর্জনের পথ তৈরি হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে এক দিনে ৬,৩০১টি গেট পাস ইস্যুর সাফল্য দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নতুন গতি যোগ করেছে। এটি ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক এবং আমদানিকারকদের জন্য সমানভাবে ইতিবাচক বার্তা।
ডিজিটালাইজেশন, অটোমেশন এবং স্মার্ট ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর এখন শুধু দেশের নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে।
যদি এই অগ্রগতি অব্যাহত থাকে, তবে অচিরেই চট্টগ্রাম বন্দর আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক ও আধুনিক বন্দরের তালিকায় উঠে আসবে—যা জাতীয় অর্থনীতিকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেবে।
MAH – 13908 I Signalbd.com



