জাতীয়

হাসিনার রায় ঘিরে আবারও ট্রাইব্যুনালের বিচারক-প্রসিকিউটরদের হত্যার হুমকি

Advertisement

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে নতুন করে উত্তেজনা, উদ্বেগ ও তৎপরতা বেড়েছে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে। রায়ের আগের দিন ও পরের কয়েকদিনে ট্রাইব্যুনালের তিন বিচারক এবং অন্তত তিন প্রসিকিউটরের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে ধারাবাহিকভাবে হত্যার হুমকি আসায় গুরুতর নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

এ ঘটনায় পুলিশ চারজনকে শনাক্ত করেছে এবং ইতোমধ্যে একজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
পুলিশের দাবি—হুমকি প্রদানকারীদের মধ্যে অধিকাংশ কল এসেছে ভারতীয় কান্ট্রি কোড ব্যবহার করে, অর্থাৎ বিদেশ থেকে অথবা ইন্টারনেট-ভিত্তিক কলিং সিস্টেম ব্যবহার করে।

হুমকির শুরু রায়ের আগের দিন থেকেই

ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে আনা ছয়টি ঘটনায় দুটি অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের রায় আসে গত সোমবার। রায় ঘোষণার আগের দিন, অর্থাৎ ১৬ নভেম্বর রাতে বিচারক ও প্রসিকিউটরদের ফোনে ক্রমাগত হুমকি আসতে থাকে।

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন—
“রায়ের আগের দিন অসংখ্য ফোন পেয়েছি। একই ভাষা, একই কথা—‘শেখ হাসিনার সাজা হলে তোমাদের জীবন শেষ করে দেব’। পরে বাধ্য হয়েই মোবাইল ফোন বন্ধ করে দিতে হয়েছিল।”

তিনি আরও বলেন,
“ভীরু, কাপুরুষ ও গণহত্যাকারীদের ভাষা এমনই হয়। এমন হুমকি আমলে নেয়ার কিছু নেই। তবে রাষ্ট্র বিষয়টি খুবই গুরুত্ব সহকারে দেখছে।”

প্রসিকিউটর তারেক আবদুল্লাহর অভিজ্ঞতা

প্রসিকিউটর তারেক আবদুল্লাহও একই ধরনের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন।
তিনি জানান—

“রোববার সন্ধ্যা থেকে অজ্ঞাত নম্বর থেকে ফোন করে হুমকি দেওয়া শুরু হয়। আজও (২০ নভেম্বর) একাধিক নম্বর থেকে ফোন পেয়েছি। অধিকাংশ ফোন ভারতের কান্ট্রি কোড ব্যবহার করে কল করা হয়েছে। ধরলে বলা হয়েছে—হাসিনার শাস্তি হলে আমাদের দলের কাউকে বাঁচতে দেওয়া হবে না।”

আইনজীবী মহল মনে করছে—এ ধরনের সমন্বিত হুমকি কোনও বিশেষ সংগঠন বা চক্রের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে দেওয়া হয়েছে, যাতে রায় ঘোষণার পর বিভ্রান্তি ও ভীতি সৃষ্টি হয়।

রায়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব

শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাটি রাজনৈতিকভাবেও অত্যন্ত সংবেদনশীল। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, গুম ও পরিকল্পিত আক্রমণ নিয়ে তদন্ত শেষে ট্রাইব্যুনাল-১ তাদের বিরুদ্ধে দোষ প্রমাণিত হয়েছে বলে রায় দিয়েছে।

ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বলা হয়—রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে জনগণের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, এবং তা মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।

এ ছাড়া পুলিশের সাবেক প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
এই রায়কে বাংলাদেশের বিচার ইতিহাসে ‘অভূতপূর্ব’ বলছেন আইন বিশেষজ্ঞরা, কারণ এর আগে কখনো কোনও ক্ষমতাসীন বা সাবেক সরকারপ্রধান মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত হননি।

হুমকিদাতারা কি বিদেশে অবস্থান করছে?

হুমকি প্রদানের ধরন ও নম্বর দেখে তদন্তকারীরা প্রাথমিকভাবে মনে করছেন—কলগুলি ভারচুয়াল নম্বর বা VOIP প্রযুক্তি দিয়ে করা হতে পারে। এমনকি কলের উৎস সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন দেশে হতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা জানান—
“এ ধরনের নম্বর সাধারণত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে দুই-তিন মিনিটের জন্য তৈরি করা যায়। ফলে অপরাধীকে শনাক্ত করা কঠিন হয়। তবে কথোপকথন, ভৌগোলিক তথ্য, ব্যবহৃত সফটওয়্যার ও কল প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে শনাক্ত করা সম্ভব।”

এরই মধ্যে সাইবার ক্রাইম ইউনিটসহ একাধিক সংস্থা তদন্তে নেমেছে।

গ্রেপ্তার ও তদন্ত অগ্রগতি

পুলিশ জানিয়েছে—তারা চারজনকে শনাক্ত করেছে, যাদের সঙ্গে হুমকি প্রদানের সম্ভাব্য যোগসূত্র পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার ব্যক্তির মোবাইল ফোন, ডিভাইস ও যোগাযোগের নেটওয়ার্ক জব্দ করা হয়েছে।

তদন্ত কর্মকর্তা জানান—
“আমরা বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। কারা, কেন এবং কোন উদ্দেশ্যে এই হুমকি দিয়েছে—সবই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রয়োজনে ইন্টারপোলের সহায়তাও নেওয়া হবে।”

বিচারকদের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে

হুমকি পাওয়ার পর ট্রাইব্যুনালের বিচারক ও প্রসিকিউটরদের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
তাদের বাসভবন, অফিস, যাতায়াত পথ এবং ট্রাইব্যুনাল এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

আইন মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান—
“এ ধরনের হুমকি বিচারিক প্রতিষ্ঠানকে ভয় দেখানোর চেষ্টা। রাষ্ট্র কখনোই এমন তৎপরতা বরদাশত করবে না।”

আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত

বহু আইন বিশেষজ্ঞ মনে করছেন—এই হুমকি বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা।
প্রফেসর আলী আশরাফ বলেন—

“ট্রাইব্যুনাল একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। বিচারক ও প্রসিকিউটরদের হুমকি দেওয়া মানে রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থার ওপর আঘাত হানা। এর কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।”

রাজনৈতিক পরিবেশ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে এই রায়কে ঘিরে মতামত, সমালোচনা ও সমর্থন মিলিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে।

কিছু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বলেছে—রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি ও তদন্ত নথি দেখে তারা আরো মন্তব্য করবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোও এ বিষয়ে বিভিন্ন বিবৃতি দিয়েছে। কেউ রায়কে “ন্যায়বিচারের বিজয়” উল্লেখ করেছে, আবার কেউ বলছে—এটি রাজনৈতিক প্রতিশোধ।

অতিরিক্ত প্রেক্ষাপট: জুলাই অভ্যুত্থান ও তদন্তের অগ্রগতি

জুলাইয়ের রাজনৈতিক টানাপড়েন, সেনা-বিভক্তি, এবং বিভিন্ন এলাকায় সশস্ত্র সংঘাতের সময় বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
সবচেয়ে আলোচিত তিনটি ঘটনা হলো—

  1. ঢাকায় বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ
  2. রাজনৈতিক বিরোধীদের গুম ও গ্রেপ্তার অভিযান
  3. মিডিয়া ও আইনজীবীদের ওপর হামলা

এই ঘটনাগুলোর ভিত্তিতেই মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত শুরু হয়।
তদন্তে দেখা যায়—অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে পরিকল্পিত আক্রমণ চালানো হয়েছিল।

ট্রাইব্যুনাল বলেছে—“প্রমাণ, সাক্ষ্য ও নথিপত্রে অপরাধ প্রমাণিত।”

জনমনে উদ্বেগ

হুমকি পাওয়ার ঘটনাটি প্রকাশ পাওয়ার পর সাধারণ মানুষের মধ্যেও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই বলছেন—আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোরভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস লিখেছেন—
“বিচারকদের হুমকি দেওয়া মানে বিচারব্যবস্থাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা। এমন ঘটনা ঘটতে থাকলে ভবিষ্যৎ বিচারিক স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়বে।”

অনেকে আবার এটিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন।

সরকারি অবস্থান

অন্তর্বর্তী সরকার জানিয়েছে—বিচারবিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এক বিবৃতিতে বলা হয়—

“বিচারকদের হুমকি দেওয়ার সাথে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো অপরাধীই আইন থেকে রেহাই পাবে না।”

শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন অধ্যায় তৈরি করেছে।
এই রায়ের পর বিচারক ও প্রসিকিউটরদের হত্যার হুমকি শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়—এটি বিচারব্যবস্থার ওপর সংগঠিত চাপ ও ভয় তৈরি করার প্রয়াস।

তবে ইতোমধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তদন্তে অগ্রগতি দেখিয়েছে এবং নিরাপত্তা জোরদার করেছে।
রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা ঘোষণা দিয়েছে—
হুমকিদাতারা যতই প্রভাবশালী হোক, আইন তাদের ছাড় দেবে না।

MAH – 13907 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button