শিক্ষা

রাবির দুই শিক্ষার্থীকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে মারধর ও অপহরণ

Advertisement

রাজশাহীতে রাতের ঘটনায় উত্তেজনা, মহাসড়ক অবরোধে শিক্ষার্থীরা**

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) এলাকায় আবারও সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। বুধবার (১৯ নভেম্বর) রাত ১০টা থেকে ১২টার মধ্যে মাত্র দেড় ঘন্টার ব্যবধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেট এলাকায় ঘটে যায় একের পর এক ভয়াবহ ঘটনা। রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া করছিলেন এমন কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর ওপর অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তরা আচমকা হামলা চালায়। শুধু হামলাই নয়—তারা দুই শিক্ষার্থীকে অপহরণ করে নির্জন এলাকায় ফেলে পালিয়ে যায়।

এই পুরো ঘটনার পর রাত সাড়ে ১২টার দিকে ক্যাম্পাস হয়ে ওঠে উত্তাল। শিক্ষার্থীরা কাজলা গেটের সামনে ঢাকা–রাজশাহী মহাসড়কে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। দাবি ওঠে, “দুর্বৃত্তদের অবিলম্বে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করতে হবে।”

ঘটনাটি জানাজানি হতেই বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে শুরু হয় উত্তেজনা, আতঙ্ক, ক্ষোভ—আর শিক্ষার্থীরা আবারও প্রশ্ন তুলছেন নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতা নিয়ে।

হামলার শিকার শিক্ষার্থীরা কারা?

হামলা ও অপহরণের শিকার শিক্ষার্থীরা হলেন—

  • আল ফারাবী, ফিন্যান্স বিভাগ, ২০২১–২২ সেশন
  • তাহমিদ আহমেদ বখশী, ফিন্যান্স বিভাগ, ২০২৩–২৪ সেশন
  • মিনহাজ, নাট্যকলা বিভাগ, ২০২৩–২৪ সেশন

এই তিনজনের মধ্যে আল ফারাবী সবচেয়ে গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। তাকে রাতেই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার পিঠ ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের দাগ রয়েছে।

আল ফারাবী রাবি ছাত্রলীগের মাদার বখশ হল শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ছিলেন। জুলাই আন্দোলনের সময় ১৫ জুলাই তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেন।

কীভাবে হামলার সূত্রপাত?

চাক্ষুষ সাক্ষীরা জানান, রাত ১১টার দিকে কাজলার ‘কাজলা ক্যান্টিন’ রেস্টুরেন্টে কয়েকজন শিক্ষার্থী খাবার খাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময় ১০–১৫টি মোটরসাইকেলে করে মুখে কালো কাপড় বাঁধা এবং হেলমেট পরা একদল সশস্ত্র লোক সেখানে আসে।

তারা রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকেই শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোনে কিছু ছবি দেখিয়ে একজনকে খুঁজতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যেই শুরু হয় এলোপাতাড়ি মারধর। হাতে ছিল—

  • রড
  • হাতুড়ি
  • রামদা
  • লোহার পাইপ
  • কাঠের লাঠি

শিক্ষার্থীরা আত্মরক্ষার সুযোগই পাননি। হামলার ভিডিও ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

এরপর তারা ফারাবী ও বখশীকে অচেতন বা অর্ধচেতন অবস্থায় তুলে মোটরসাইকেলে করে নিয়ে যায়

অপহরণের পর কোথায় পাওয়া গেল শিক্ষার্থীরা?

রাত প্রায় ১১টা ৪৫ মিনিটে এলাকাবাসী প্রথম ফারাবীকে দেখতে পান বিনোদপুর বেতার মাঠের পাশে
তাহমিদ বখশীকে পাওয়া যায় হবিবুর রহমান হলের সামনে

দু’জনকেই তখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা বিভাগ ও ছাত্ররা উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যায়।

মিনহাজ রেস্টুরেন্টেই আহত হন। তাকে তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া হয়।

শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ: মহাসড়ক অবরোধ ও আগুন

হামলার খবর ছড়িয়ে পড়তেই রাত সাড়ে ১২টার দিকে শত শত শিক্ষার্থী কাজলা গেটে জড়ো হন। শিক্ষার্থীরা—

  • ঢাকা–রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেন
  • টায়ারে আগুন ধরিয়ে বিক্ষোভ করেন
  • হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান
  • নিরাপত্তাহীনতার প্রতিবাদে স্লোগান দেন

অনেকেই বলেন, “ক্যাম্পাসের ভেতরে যদি এমন সন্ত্রাসী হামলা হয়, তাহলে আমরা নিরাপদ কোথায়?”

বিক্ষোভের কারণে মহাসড়কে যান চলাচল কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকে। পুলিশের উপস্থিতিতে ভোরের দিকে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়।

প্রক্টর অফিস কী বলছে?

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবর রহমান বলেন—

“মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে এবং দুজনকে তুলে নিয়ে গেছে। পরে আমরা তাদের উদ্ধার করেছি। পুলিশকে অবহিত করা হয়েছে, দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের শনাক্ত করা হবে।”

তিনি শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানান।

পুলিশের প্রাথমিক ধারণা

রাজশাহী মহানগর পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে—
প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে এটি একটি পরিকল্পিত হামলা
এর সাথে ব্যক্তিগত বিরোধ, আগের রাজনৈতিক তৎপরতা বা শিক্ষার্থীদের কোনো অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব জড়িত থাকতে পারে।

তবে পুলিশ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু নিশ্চিত করেনি।

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কেন বাড়ছে সহিংসতা?

শিক্ষার্থীরা বলছেন, গত কয়েক মাসে রাবি এলাকায়—

  • দলীয় কোন্দল
  • পূর্বশত্রুতা
  • বাহিরের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ
  • চাঁদাবাজি
  • ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা

এসব কারণে ঘটনাগুলো বেড়েই চলেছে।

বিশেষ করে কাজলা, বিনোদপুর, বাঁকির মোড়—এই তিন গেটের আশপাশে প্রায়ই সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী চক্রের গতিবিধি লক্ষ করা যায় বলে জানান স্থানীয়রা।

অনেক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন—

“নিরাপত্তা নামেই শুধু গার্ড। দুষ্কৃতিকারীরা মোটরসাইকেল নিয়ে চলে আসে, হামলা করে পালিয়ে যায়।”

স্থানীয়দের বক্তব্য

কাজলা এলাকার দোকানদাররা বলেন—

  • “রাতে বাইরের অনেক লোকজন মোটরসাইকেল নিয়ে এলাকায় ঘোরাঘুরি করে।”
  • “হেলমেট পরে থাকা লোকজনকে শনাক্ত করা কষ্টকর।”
  • “সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলেও সবই কাজ করে না।”

তাদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ মিলে এলাকায় শক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।

রামেক হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের মন্তব্য

রামেকের জরুরি বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন—

“আল ফারাবীর পিঠে ভারী কিছু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন সুস্পষ্ট। শরীরের আরও কয়েকটি জায়গায় আঘাত আছে। পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।”

তাহমিদ বখশীর আঘাত তুলনামূলক কম হলেও তিনি মানসিকভাবে ভীষণ ভয়ে আছেন।

শিক্ষার্থীদের দাবি

১. হামলাকারীদের দ্রুত শনাক্ত ও গ্রেপ্তার
২. বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিরাপত্তা বৃদ্ধি
৩. কাজলা–বিনোদপুর–মতিহার এলাকায় সিসিটিভি আরো স্থাপন
৪. বাইরের সন্ত্রাসী চক্রকে প্রবেশে বাধা
৫. রাতের পর গেট এলাকায় পুলিশের টহল বাড়ানো
৬. তদন্তের জন্য আলাদা কমিটি

তারা আরও বলেন—

“রাবি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ছাড়া আমরা ভর্তি ফি দিই না, মেস–হোস্টেল ভাড়া দিই না। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশের।”

অতীতে এমন ঘটনা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত কয়েক বছরে একাধিকবার সন্ত্রাসী হামলা, মারধর, গুলিবর্ষণ ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে—

  • ২০১৪ সালে রাবির ভেটেরিনারি ভবনে গুলি চালনার ঘটনা
  • ২০২১ সালে ছাত্র সংগঠনের মধ্যকার সংঘর্ষ
  • ২০২৩ সালে বাঁকির মোড়ে সংঘবদ্ধ হামলা
  • ২০২৪ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ধারালো অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি ঘটনার পর তদন্ত হলেও অপরাধীদের খুব কমই আইনের আওতায় আনা হয়।

ক্যাম্পাসের পড়াশোনা ও পরিবেশে প্রভাব

শিক্ষার্থীরা মনে করছেন—
এ ধরনের ঘটনা ক্যাম্পাসের শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে নষ্ট করছে।
আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদের যাতায়াতও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

অনেকে বলছেন—

“শীতের টার্ম ফাইনাল এগিয়ে এসেছে। এ অবস্থায় মানসিক চাপ নিয়ে পড়াশোনা অসম্ভব হয়ে পড়ছে।”

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পরবর্তী পদক্ষেপ

প্রক্টর অফিস জানিয়েছে—

  • ঘটনার ভিডিও সংগ্রহ করা হচ্ছে
  • সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হবে
  • রাত থেকেই পুলিশের কয়েকটি টিম তদন্তে নেমেছে
  • শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় অতিরিক্ত টহল বাড়ানো হয়েছে

এছাড়া, পরবর্তীতে বিশেষ নিরাপত্তা কমিটি গঠন করা হতে পারে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের অন্যতম বৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলা ও অপহরণের ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন—যা শিক্ষা পরিবেশের জন্য বড় হুমকি।

দুর্বৃত্তদের দ্রুত শনাক্ত ও গ্রেপ্তার না হলে এ ধরনের ঘটনা আরও বাড়তে পারে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

SignalBD.com এ ঘটনার সবশেষ আপডেট জানানো হবে।

MAH – 13891 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button