সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র সফরে আসা সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স ও প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমানকে হোয়াইট হাউসে নজিরবিহীন ও উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর যুবরাজ সালমানই একমাত্র বিদেশি অতিথি, যার আপ্যায়নে এত জাঁকজমক ও আতিথেয়তার ছাপ দেখা গেছে। রাষ্ট্রপ্রধান না হয়েও মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) হোয়াইট হাউসে তাকে যে সম্মান দেওয়া হয়েছে, তা বিশ্বের অন্যান্য ঘনিষ্ঠ মিত্রদের ক্ষেত্রেও বিরল। এই মহা-আড়ম্বরপূর্ণ অভ্যর্থনার মূল কারণ হলো এক ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য চুক্তি এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সামরিক স্বার্থ।
হোয়াইট হাউসের জমকালো আয়োজন
সৌদি যুবরাজের আগমন উপলক্ষে এদিন ভিন্ন সাজে মেতে ওঠে হোয়াইট হাউস। জাঁকজমক আয়োজনে কোনো কমতি রাখেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
আনুষ্ঠানিকতা: লাল গালিচা সংবর্ধনা থেকে শুরু করে তোপধ্বনি, অশ্বারোহী বাহিনীর আনুষ্ঠানিক শোভাযাত্রা এবং সামরিক ব্যান্ডের পসরা সাজানো হয়েছিল। পুরো হোয়াইট হাউস প্রাঙ্গণে যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি আরবের পতাকা ওড়ানো হয়।
গার্ড অব অনার: যুবরাজ সালমান হোয়াইট হাউসে পৌঁছানোর পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে তার করমর্দনের পরপরই হোয়াইট হাউসের মাথার ওপর দিয়ে ৬টি এফ-৩৫ ও এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ‘ভি’ আকৃতিতে উড়ে গিয়ে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করে। এই সামরিক সম্মান সচরাচর বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদেরও দেওয়া হয় না।
প্রেসিডেন্টের উপস্থিতি: ট্রাম্প সচরাচর ফটকের সামনে অতিথির জন্য অপেক্ষা করেন না। কিন্তু যুবরাজ সালমানের জন্য তিনি সাউথ লনের ফটকের সামনে লাল গালিচায় দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং গাড়ি থেকে নামতেই দুই পা এগিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে করমর্দন করেন।
দিনের কূটনৈতিক কর্মসূচি
হোয়াইট হাউসে যুবরাজ সালমানের জন্য ছিল দিনব্যাপী ব্যস্ত কূটনৈতিক কর্মসূচি।
দ্বিপাক্ষিক বৈঠক: অভ্যর্থনার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাকে রোজ গার্ডেনের পাশে প্রেসিডেন্টদের নবনির্মিত প্রতিকৃতি গ্যালারি ঘুরিয়ে দেখান। এরপর ওভাল অফিসে দুই নেতার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
মধ্যাহ্নভোজ ও নৈশভোজ: দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর ক্যাবিনেট রুমে মধ্যাহ্নভোজে যোগ দেন যুবরাজ সালমান। সন্ধ্যায় তাকে আরও একবার লাল গালিচা অভ্যর্থনা জানানো হয়। সে সময় ইস্ট রুমে তার সম্মানে আয়োজন করা হয়েছিল আড়ম্বরপূর্ণ ‘ব্ল্যাক-টাই’ ক্যান্ডেললাইট ডিনারের।
ডিনারে শীর্ষ ব্যক্তিত্ব: ঐতিহাসিক ওই নৈশভোজে বিশ্বের প্রায় ১২০ জন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন, যার মধ্যে ছিলেন শিল্পপতি ইলন মাস্ক এবং ফুটবল তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।
আলোচনার মূল বিষয়বস্তু: সামরিক চুক্তি ও অর্থনীতি
দুই নেতার আলোচনায় মূলত নিরাপত্তা সম্পর্ক, বহু-বিলিয়ন ডলারের ব্যবসায়িক চুক্তি এবং কৌশলগত সামরিক সহযোগিতা প্রাধান্য পেয়েছে।
বাণিজ্য চুক্তি: ট্রাম্প মে মাসে সৌদি সফরে ৬০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে আরও প্রকল্প এগিয়ে নিতে চান। মার্কিন প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই সফরে এক ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য চুক্তির প্রতিশ্রুতি নিয়ে আলোচনা হয়।
সামরিক সহযোগিতা: আলোচনায় প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রি, বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা নিয়ে চুক্তি হওয়ার আশা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের কাছে অত্যাধুনিক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রি করার বিষয়ে নীতিগত পরিবর্তন আনার ঘোষণা দিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক ভারসাম্য: এটি সৌদি আরবের কাছে প্রথম মার্কিন এফ-৩৫ বিক্রি হতে পারে। এই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক ভারসাম্য বদলে দিতে পারে এবং ইসরায়েলের সামরিক প্রাধান্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে নতুন করে পরীক্ষা করবে।
মানবাধিকার ও খাশোগি প্রসঙ্গ
২০১৮ সালের ইস্তান্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার পর এটিই যুবরাজ সালমানের প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফর। এই সফর নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো তীব্র হতাশা প্রকাশ করেছে।
ট্রাম্পের অবস্থান: সমালোচনার মুখে ট্রাম্প দৃঢ়ভাবে যুবরাজ সালমানের পক্ষ নিয়েছেন। ওভাল অফিসে ট্রাম্প বলেন, সালমান তার ‘খুব ভালো বন্ধু’ এবং ‘খাশোগি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে প্রিন্স সালমান কিছুই জানতেন না’ বলে তিনি দাবি করেন। ট্রাম্প আরও বলেন যে, মানবাধিকার বিষয়ে সালমানের কাজ ‘প্রশংসনীয়’।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিক্রিয়া: আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখেও হোয়াইট হাউসে এমন উচ্চপর্যায়ে অভ্যর্থনা পাওয়ায় মানবাধিকার সংগঠনগুলো হতাশা ব্যক্ত করেছে। ডন এর নির্বাহী পরিচালক সারা লিয়া হুইটসন বলেন, সালমানের এমন অভ্যর্থনা এক অসাধারণ রাজনৈতিক পরিবর্তন।
কৌশলগত নিরাপত্তা ও ইসরায়েল সম্পর্ক
দ্বিপাক্ষিক আলোচনার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যে কৌশলগত নিরাপত্তা সম্পর্ক জোরদার করা।
নতুন নিরাপত্তা নিশ্চয়তা: সৌদি নেতা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নতুন নিরাপত্তা নিশ্চয়তা চাইছেন। একজন শীর্ষ মার্কিন প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ট্রাম্প কাতারকে দেওয়া প্রতিরক্ষা প্রতিশ্রুতির ধাঁচে একটি নির্বাহী আদেশ জারি করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
ইসরায়েল প্রসঙ্গ: যদিও আলোচনায় সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে বড় ধরনের কোনো অগ্রগতি হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম তেল রপ্তানিকারক সৌদি আরবের সঙ্গে এই সম্পর্ক ট্রাম্প প্রশাসনকে মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
“সালমান আমার খুব ভালো বন্ধু এবং মানবাধিকার বিষয়ে তার কাজ প্রশংসনীয়। প্রিন্স সালমান খাশোগি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কিছুই জানতেন না।” — ডোনাল্ড ট্রাম্প (মার্কিন প্রেসিডেন্ট, ওভাল অফিসে)
হোয়াইট হাউসে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উষ্ণ অভ্যর্থনা স্পষ্টতই ওয়াশিংটন ও রিয়াদের মধ্যে কৌশলগত ও বাণিজ্যিক সম্পর্ককে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার ইঙ্গিত বহন করে। এক ট্রিলিয়ন ডলারের চুক্তি এবং এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের সম্ভাব্য বিক্রির মতো বিষয়গুলো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্পের এই নজিরবিহীন আতিথেয়তা প্রমাণ করে যে, আমেরিকার কাছে অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থই এখন প্রধান। এই সফরটি সৌদি আরবের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে কাজ করবে, যদিও মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।
এম আর এম – ২৩১৫,Signalbd.com



