আঞ্চলিক

সেতুতে উঠতে না দেওয়ায় পদ্মা নদী সাঁতরে পার হওয়ার চেষ্টা, অসুস্থ ২

Advertisement

বরিশাল-ভোলা রুটে অবিলম্বে সেতু নির্মাণের দাবিতে পায়ে হেঁটে ঢাকামুখী লংমার্চে অংশ নেওয়া একদল যুবক বুধবার (১৯ নভেম্বর) বিকেলে এক দুঃসাহসিক প্রতিবাদের পথ বেছে নেন। কর্তৃপক্ষ তাদের পদ্মা সেতু দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অনুমতি না দেওয়ায় তারা ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ প্রমত্তা পদ্মা নদী সাঁতরে পার হওয়ার চেষ্টা করেন। এই ঝুঁকিপূর্ণ প্রচেষ্টার কারণে তাদের মধ্যে দুইজন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং দ্রুত তাদেরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই ঘটনাটি ভোলা জেলার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ও দুর্ভোগের প্রতি তাদের চরম হতাশা এবং প্রতিবাদকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।

বিস্তারিত 

এই লংমার্চের সূত্রপাত এবং নদী সাঁতরে পার হওয়ার প্রচেষ্টার পেছনের কারণগুলো দীর্ঘদিনের নাগরিক দুর্ভোগের সঙ্গে সম্পর্কিত।

  • লংমার্চের দাবি: লংমার্চকারীদের প্রধান দাবি হলো বরিশাল ও ভোলা রুটে একটি সেতু নির্মাণ। দ্বীপজেলা ভোলার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে বরিশাল বিভাগীয় সদর এবং দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে মারাত্মক দুর্ভোগের শিকার। জরুরি পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে রোগীদের দ্রুত বরিশালে বা দেশের অন্য প্রান্তে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
  • পদযাত্রার শুরু: ভোলার ২০ তরুণ-যুবক তাদের এই দাবি কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্যে গত ১১ নভেম্বর ভোলার চরফ্যাশন টাওয়ার থেকে পায়ে হেঁটে ঢাকার সেতু ভবন পর্যন্ত লংমার্চ শুরু করেন।
  • জাজিরা প্রান্তে পৌঁছানো: পদযাত্রার অষ্টম দিনে তারা পদ্মা সেতুর শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে পৌঁছান। কিন্তু পদ্মা সেতুর নিরাপত্তার কারণে কর্তৃপক্ষ তাদেরকে সেতু দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

দুঃসাহসিক নদী পারাপারের চেষ্টা

সেতু দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অনুমতি না মেলায় হতাশ হয়ে লংমার্চকারীরা প্রতিবাদস্বরূপ ছয় কিলোমিটার নদীপথ সাঁতরে পার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

  • সাঁতার শুরু: ২০ জন লংমার্চকারীর মধ্যে প্রায় ১০ জন এই বিপজ্জনক সাঁতার শুরু করেন।
  • অসুস্থতা ও উদ্ধার: সাঁতার শুরু করার কিছুক্ষণ পর নোমান হাওলাদারতানজিম নামে দুইজন যুবক অসুস্থ হয়ে পড়েন। নদীপথের তীব্র স্রোত এবং ক্লান্তির কারণে তারা দুর্বল হয়ে পড়েন।
  • হাসপাতালে ভর্তি: স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় দ্রুত তাদের উদ্ধার করা হয় এবং শিবচরের পাচ্চর এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে তারা চিকিৎসাধীন আছেন।

লংমার্চ সমন্বয়কারীর কড়া প্রতিক্রিয়া

এই ঘটনার পর লংমার্চ সমন্বয়কারী মীর মোশাররফ অমি কর্তৃপক্ষের প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং তাদের দাবির প্রতি সরকারের উদাসীনতাকে দায়ী করেছেন।

  • দাবি পূরণে ব্যর্থতা: মীর মোশাররফ অমি বলেন, “ভোলা-বরিশাল রুটে সেতুর দাবিতে আমরা বহুবার হতাশ হয়েছি। ২০১৩ সালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কথা থাকলেও ২০২৫ সালেও তা হয়নি। ফিজিবিলিটি স্টাডির পরও বারবার প্রকল্প বাতিল করা হয়।”
  • কর্তৃপক্ষকে দায়ী: সেতু দিয়ে হাঁটার অনুমতি না পাওয়ায় বাধ্য হয়েই নদী পার হওয়ার চেষ্টা করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যদি কোনো মৃত্যুঘটনা ঘটে, তার দায় কর্তৃপক্ষকেই নিতে হবে।” এই মন্তব্যটি ঘটনাটির গুরুত্ব এবং লংমার্চকারীদের চরম হতাশার মাত্রা নির্দেশ করে।

পুলিশের বক্তব্য ও বর্তমান অবস্থান

নদী সাঁতরাতে যাওয়ার বিষয়ে শরীয়তপুর জেলা পুলিশ কর্তৃপক্ষও তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে।

  • আইনি বাধ্যবাধকতা: শরীয়তপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গোসাইরহাট সার্কেল) শামসুল আরেফীন জানান, “সেতু দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অনুমতি নেই।” মূলত পদ্মা সেতুর নিরাপত্তা ও বিধিবিধান মেনেই কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।
  • বর্তমান অবস্থা: তিনি আরও জানান, সাঁতরাতে যাওয়া যুবকদের উদ্ধার করার পর বর্তমানে তারা শরীয়তপুরের একটি চরে অবস্থান করছেন। তাদের পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে আলোচনা চলছে।

ভোলা-বরিশাল সেতু প্রকল্পের পূর্ব ইতিহাস

ভোলা-বরিশাল সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি দীর্ঘদিন ধরে সরকারের পরিকল্পনায় থাকলেও নানা কারণে তা বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে।

  • দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ: ভোলা জেলার লক্ষ লক্ষ মানুষ যুগ যুগ ধরে এই রুটে ফেরি বা নৌপথের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে কৃষি পণ্য পরিবহন, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিক্ষাক্ষেত্রে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে তারা পিছিয়ে পড়ছেন।
  • পরিকল্পনা ও বাতিল: ২০১৩ সালে এই সেতু প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের প্রাথমিক ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। ফিজিবিলিটি স্টাডি বা সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজও হয়েছিল, কিন্তু বারবার রাজনৈতিক বা আর্থিক কারণে প্রকল্পটি বাতিল বা স্থগিত করা হয়েছে। এই বিলম্ব স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।

প্রতিবাদের প্রভাব ও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ

এই দুঃসাহসিক প্রতিবাদ স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

  • জাতীয় মনোযোগ: লংমার্চকারীরা তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে প্রতিবাদ করেছেন, তা এই গুরুত্বপূর্ণ দাবিটির প্রতি সরকারের উচ্চপর্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। জনগণের দুর্ভোগ ও দীর্ঘদিনের দাবির প্রতি কর্তৃপক্ষের সংবেদনশীলতা বাড়ানো এই প্রতিবাদের মূল লক্ষ্য।
  • আইন ও মানবিকতা: পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার কারণে তাদের হেঁটে যাওয়ার অনুমতি না দিয়ে সঠিক কাজ করেছে। তবে নদী সাঁতরে পার হওয়ার চেষ্টা মানবিক দিক থেকে সরকারের জন্য একটি বার্তা বহন করে। এই ধরনের ঝুঁকি এড়াতে ভবিষ্যতে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের জন্য বিকল্প রুট বা পদ্ধতির ব্যবস্থা করা জরুরি।

বরিশাল-ভোলা রুটে সেতু নির্মাণের দাবিতে লংমার্চে অংশ নেওয়া যুবকদের পদ্মা নদী সাঁতরে পার হওয়ার এই মরিয়া প্রচেষ্টা তাদের দীর্ঘদিনের হতাশার এক চরম বহিঃপ্রকাশ। তাদের দুই সহযোদ্ধার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির ঘটনা এই দাবির মানবিক দিকটিকে আরও স্পষ্ট করেছে। পদ্মা সেতুতে নিরাপত্তার কারণে হেঁটে যাওয়ার অনুমতি না দেওয়া হলেও, এই আন্দোলন প্রমাণ করে যে ভোলাবাসীর দাবিটি আর উপেক্ষা করা উচিত নয়। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখন এই প্রতিবাদকারীদের দাবি ও দুর্ভোগের দিকে দ্রুত নজর দিতে হবে এবং সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে একটি চূড়ান্ত সময়সীমা ঘোষণা করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিবাদের প্রয়োজন না হয়।

এম আর এম – ২৩১১,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button