আঞ্চলিক

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাষ্প নির্গমন শুরু বৃহস্পতিবার, আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ

Advertisement

পাবনার ঈশ্বরদীতে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্বাভাবিক কার্যক্রম ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) থেকে শুরু হতে যাচ্ছে বাষ্প নির্গমন পরীক্ষা। এই পরীক্ষা চলার সময় উচ্চচাপের বাষ্প নির্গত হওয়ার কারণে জেট ইঞ্জিনের মতো বিকট শব্দ সৃষ্টি হতে পারে। এতে স্থানীয় জনসাধারণ যাতে কোনো ধরনের ভয় বা আতঙ্কে না ভোগেন, সেজন্য আগাম সতর্কতা জারি করেছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে যে, এই উচ্চ শব্দের ঘটনাটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, পূর্বনির্ধারিত এবং সম্পূর্ণ নিরাপদ। এটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থায়িত্ব ও মান যাচাইয়ের একটি নিয়মিত কারিগরি প্রক্রিয়া।

বাষ্প নির্গমন পরীক্ষার বিস্তারিত

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হলো এই বাষ্প নির্গমন পরীক্ষা। এটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা ও কার্যক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য অপরিহার্য।

  • সময়কাল: বুধবার (১৯ নভেম্বর) সন্ধ্যায় গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক তথ্য কর্মকর্তা ও ফোকাল পয়েন্ট সৈকত আহমেদ জানান, বৃহস্পতিবার থেকে এই বাষ্প নির্গমন পরীক্ষা শুরু হবে, যা একটানা ৪ থেকে ৫ দিন ধরে পরিচালিত হতে পারে।
  • পরীক্ষার উদ্দেশ্য: এই পরীক্ষা মূলত মেইন স্টিম পাইপলাইন এবং স্টিম জেনারেটরের নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা যাচাইয়ের অংশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করার আগে সিস্টেমের ত্রুটিমুক্ত অপারেশন নিশ্চিত করাই এর প্রধান লক্ষ্য।
  • কারিগরি প্রক্রিয়া: রাশিয়ান সাধারণ ঠিকাদার JSC-ASE প্রকল্পটি এলাকায় এই পরিকল্পিত পরীক্ষা সম্পন্ন করবে। পরীক্ষার সময় নির্দিষ্ট ভালভের মাধ্যমে উচ্চচাপের বাষ্প বায়ুমণ্ডলে নিঃসৃত হবে।

শব্দ সৃষ্টির কারণ ও নিরাপত্তার আশ্বাস

প্রকল্প এলাকার কাছাকাছি বসবাসরত স্থানীয়দের মধ্যে উচ্চ শব্দ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই এক ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি হতে পারে। তবে কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছে।

  • শব্দের প্রকৃতি: বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, উচ্চচাপের বাষ্প বায়ুমণ্ডলে নিঃসৃত হওয়ার সময় বাতাসের সাথে সংঘর্ষের ফলে তীব্র শব্দ সৃষ্টি হবে, যা অনেকটা জেট ইঞ্জিনের শব্দের মতো। এই শব্দ অস্থায়ী এবং কেবল পরীক্ষার সময়টুকুর জন্যই শোনা যাবে।
  • নিরাপত্তার নিশ্চয়তা: কর্তৃপক্ষ স্থানীয়দের উদ্দেশ্যে জানিয়েছে যে, এই বিকট শব্দ স্বাভাবিক এবং সম্পূর্ণ নিরাপদ। এটি পারমাণবিক চুল্লির বা তেজস্ক্রিয় কোনো পদার্থের নির্গমন নয়, বরং এটি একটি অ-তেজস্ক্রিয় বাষ্প, যা পরিবেশ বা মানুষের জন্য কোনো ঝুঁকি বা বিপদের কারণ নয়।
  • আন্তর্জাতিক মান: কর্তৃপক্ষ আরও জানিয়েছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থায়িত্ব, মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশ্বব্যাপী এ ধরনের চাপ ও বাষ্প নির্গমন পরীক্ষা নিয়মিতভাবে সম্পন্ন করা হয় এবং এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি প্রক্রিয়া।

স্থানীয়দের প্রতি কর্তৃপক্ষের বার্তা

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতি সতর্ক এবং সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়েছে।

  • ভয় বা আতঙ্ক পরিহার: প্রকল্প কর্তৃপক্ষ স্থানীয় জনগণের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে, এই শব্দে যেন তারা কোনোভাবেই ভয় বা আতঙ্কের সৃষ্টি না করেন। গুজব বা ভুল তথ্যে কান না দেওয়ার জন্যও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
  • যোগাযোগ ব্যবস্থা: এই সময়ে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বা প্রশ্নের সম্মুখীন হলে স্থানীয় প্রশাসন বা সরাসরি প্রকল্প কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্তমান অবস্থা

বাষ্প নির্গমন পরীক্ষার মাধ্যমে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইউনিট-১ এর বাণিজ্যিক উৎপাদনের দিকে আরও এক ধাপ অগ্রগতি হলো।

  • দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলো বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প। এর প্রথম ইউনিট থেকে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করার লক্ষ্য রয়েছে।
  • উৎপাদন ক্ষমতা: প্রতিটি ইউনিটের উৎপাদন ক্ষমতা ১,২০০ মেগাওয়াট। দুটি ইউনিট চালু হলে মোট ২,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর জন্য এই প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  • ভিভিইআর ১২০০ চুল্লি: বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে রাশিয়ার ভিভিইআর ১২০০ মডেলের তৃতীয় প্রজন্মের চুল্লি ব্যবহার করা হচ্ছে, যা উচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন।

বাষ্প নির্গমন পরীক্ষার গুরুত্ব ও পরবর্তী ধাপ

এই ধরনের পরীক্ষাগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্রের সামগ্রিক সিস্টেমকে যাচাই করে। বিশেষত মেইন স্টিম পাইপলাইন এবং স্টিম জেনারেটরের মতো গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জামগুলো সর্বোচ্চ চাপে সঠিকভাবে কাজ করে কি না, তা নিশ্চিত করা হয়।

  • স্থায়িত্ব যাচাই: উচ্চচাপের বাষ্প নির্গমনের মাধ্যমে পাইপলাইন এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতির যান্ত্রিক স্থায়িত্ব পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন হলে প্ল্যান্টের মূল কাজগুলোর নিরাপত্তা ও কর্মদক্ষতা নিশ্চিত হবে।
  • পরবর্তী ধাপ: বাষ্প নির্গমন পরীক্ষা সফলভাবে শেষ হওয়ার পর বিদ্যুৎকেন্দ্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা যেমন টারবাইন ঘূর্ণন এবং পর্যায়ক্রমে বিদ্যুতের সাথে জাতীয় গ্রিডের সংযোগের কাজ শুরু হবে। এটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার পূর্বের চূড়ান্ত ধাপগুলোর মধ্যে অন্যতম।

কর্তৃপক্ষের বার্তা

“উচ্চচাপের বাষ্প নির্গমনের সময় বিকট শব্দ স্বাভাবিক ও সম্পূর্ণ নিরাপদ। এতে জনসাধারণের কোনো ঝুঁকি বা বিপদের শঙ্কা নেই। এটি নিয়মিত কারিগরি প্রক্রিয়া, যা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পরিচালিত হচ্ছে।” — সৈকত আহমেদ (ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক তথ্য কর্মকর্তা ও ফোকাল পয়েন্ট, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র)

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাষ্প নির্গমন পরীক্ষার শুরু হওয়া দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাইলফলকের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। যদিও উচ্চ শব্দের কারণে স্থানীয়দের মধ্যে সাময়িক উদ্বেগ সৃষ্টি হতে পারে, তবে কর্তৃপক্ষের দেওয়া নিরাপত্তা ও স্বাভাবিকতার আশ্বাস অনুযায়ী এটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্যক্রমের জন্য একটি নিয়মিত এবং গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই পরীক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন হলে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের বিদ্যুৎ খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। স্থানীয়দের প্রতি অনুরোধ, তারা যেন গুজবে কান না দিয়ে কর্তৃপক্ষের তথ্যের ওপর আস্থা রাখেন।

এম আর এম – ২৩০৯,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button