বিশ্ব

নেতানিয়াহু নিউইয়র্কে এলেই গ্রেপ্তার হবেন: মামদানি

Advertisement

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যদি নিউইয়র্ক সফরে আসেন, তবে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন শহরটির নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানি। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে সম্প্রতি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এই পরোয়ানাকে কার্যকর করার বিষয়ে মেয়র মামদানি তার দৃঢ় অবস্থানের কথা ঘোষণা করলেন। তিনি নিউইয়র্ককে ‘আন্তর্জাতিক আইনের শহর’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এই আইনকে সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার করেছেন।

মামদানির কঠোর অবস্থান ও আইসিসি’র পরোয়ানা

মেয়র জোহরান মামদানি সরাসরি সম্প্রচার অনুষ্ঠান এবিসি৭-এ যোগ দিয়ে এই ঘোষণা দেন। তার এই ঘোষণা এমন এক সময়ে এলো, যখন নিউইয়র্কের বিদায়ী মেয়র এরিক অ্যাডামস ইসরায়েল সফরকালে নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে মামদানির অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান।

  • আন্তর্জাতিক আইনের শহর: মামদানি জোর দিয়ে বলেন যে, তিনি নিউইয়র্ক শহরকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের শহর’ হিসেবে বিশ্বাস করেন। তার মতে, আন্তর্জাতিক আইনের শহর হওয়ার অর্থ হলো সেই আইনকে রক্ষা করা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বহাল রাখা।
  • পরোয়ানার কারণ: আইসিসি ২০২৪ সালে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। পরোয়ানায় তার বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে গাজার বেসামরিক জনগণের ওপর হামলা চালানো এবং যুদ্ধের কৌশল হিসেবে ক্ষুধাকে ব্যবহার করার মতো গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে।
  • অন্যান্য অপরাধী: মামদানি তার অবস্থান স্পষ্ট করে বলেন, এই পরোয়ানা শুধুমাত্র বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য নয়, বরং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধে অভিযুক্ত যে কারও ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তারের আইনি ভিত্তি

নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তার নিশ্চিত করতে কোনো নতুন আইন প্রণয়নের আশ্রয় নেবেন না বলে জানিয়েছেন মেয়র মামদানি। বরং তিনি বিদ্যমান আইনের মধ্যেই সব ধরনের আইনি সম্ভাবনা খুঁজে দেখবেন।

  • বিদ্যমান আইন: তিনি বলেন, “আমি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো নই। আমি এমন একজন, যে বিদ্যমান আইনের মধ্যেই থাকতে চায়। তাই আমি নিজে থেকে কোনো আইন বানাব না। বরং বিদ্যমান আইনের ভেতরে থেকে সব ধরনের আইনগত সম্ভাবনা খুঁজে দেখব।”
  • নির্বাচনের পূর্বের অবস্থান: মেয়র নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগেও গত অক্টোবর মাসে ফক্স নিউজের দ্য স্টোরি অনুষ্ঠানে মার্থা ম্যাককালামের সঙ্গে আলাপচারিতায় মামদানি বলেছিলেন, যদি আইনগত অনুমতি থাকে, তবে তিনি নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তার করবেন। তার মতে, নিউইয়র্ক এই ধরনের ‘নীতিকে সমুন্নত ও সংরক্ষণ করতে চায়’।

এটি গুরুত্বপূর্ণ যে, যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ নয়। এই কারণে আইসিসির পরোয়ানা আমেরিকায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। তবে স্থানীয় বা অঙ্গরাজ্য পর্যায়ে আইনি সহায়তার মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া যায় কি না, মামদানি সেই সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার কথা বলছেন।

বিদায়ী মেয়রের ভূমিকা ও রাজনৈতিক বিভাজন

মামদানির এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে বিদায়ী মেয়র এরিক অ্যাডামসের ভূমিকা এবং এই বিষয়ে নিউইয়র্কের রাজনৈতিক মহলের বিভাজন স্পষ্ট হয়েছে।

  • অ্যাডামসের আমন্ত্রণ: অ্যাডামস নেতানিয়াহুকে নিউইয়র্ক সফরের এবং মামদানির শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। এই আমন্ত্রণ ইসরায়েল এবং নেতানিয়াহুর প্রতি একটি বন্ধুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে।
  • মামদানির সমালোচনার প্রতিক্রিয়া: মামদানির এই কঠোর অবস্থান নিউইয়র্ক শহরকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও আইনের পক্ষে একটি শক্তিশালী অবস্থান নিতে সাহায্য করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার এই মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি বিদায়ী মেয়রের নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নবনির্বাচিত মেয়র হিসেবে মামদানি এই ধরনের আন্তর্জাতিক বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়ে তার প্রগতিশীল ও মানবাধিকারপন্থী ভোটারদের কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা দিলেন।

আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানার গুরুত্ব

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) কর্তৃক একজন ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা আন্তর্জাতিক আইনের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা।

  • গাজার পরিস্থিতি: এই পরোয়ানা গাজা উপত্যকায় সংঘটিত মারাত্মক মানবিক বিপর্যয় ও ইসরায়েলের সামরিক কার্যকলাপের জন্য সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করে। পরোয়ানার অভিযোগে ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক জনগণের ওপর আক্রমণ এবং মানবিক সহায়তায় বাধা সৃষ্টি করে ‘ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার’ করার মতো বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে।
  • আন্তর্জাতিক চাপ: যদিও যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির সদস্য নয়, তবু এই পরোয়ানা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতানিয়াহুর ওপর নৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করবে। বিভিন্ন দেশে তার সফরে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি বাধা হিসেবে কাজ করবে।

বিশেষজ্ঞ মতামত ও আইনি জটিলতা

আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আইসিসি সদস্য না হওয়ায় নেতানিয়াহুকে নিউইয়র্কে গ্রেপ্তার করা আইনিভাবে অত্যন্ত জটিল ও কঠিন হবে।

  • যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা: যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহ্যগতভাবে তার নাগরিকদের বা তার মিত্র দেশগুলোর নেতাদের আইসিসির এখতিয়ার থেকে রক্ষা করে এসেছে। আইসিসির পরোয়ানা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র সরকার নেতানিয়াহুকে কূটনৈতিক সুরক্ষা দিতে পারে।
  • স্থানীয় এখতিয়ার: তবে, নিউইয়র্ক সিটি বা অঙ্গরাজ্য যদি নিজস্ব এখতিয়ারে আন্তর্জাতিক আইনের কোনো ধারা বা নীতি অনুসরণ করে, তবে মেয়র মামদানি সেই পথ ধরে এগোনোর চেষ্টা করতে পারেন। এটি নিউইয়র্কের জন্য এক নজিরবিহীন পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ট্রানজিশন

নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তারের ঘোষণার পাশাপাশি, মামদানির ট্রানজিশন দলের অর্থনৈতিক দিকটিও খবরে উঠে এসেছে। সিবিএস-এর খবরে বলা হয়েছে, দায়িত্ব গ্রহণের সময় ‘ট্রানজিশন’ দলের খরচের জন্য সমর্থকদের কাছে অনুদান চেয়েছেন মামদানি। তিনি জানান, তার প্রচারণা দল এখন পর্যন্ত ১০ লাখ ডলার সংগ্রহ করতে পেরেছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, মেয়র হিসেবে তার কাজ শুরু করার জন্য আর্থিক প্রস্তুতি চলছে।

মেয়র মামদানির নীতিগত অবস্থান

“আমি বারবার বলেছি যে আমি বিশ্বাস করি, এটি আন্তর্জাতিক আইনের শহর। আন্তর্জাতিক আইনের শহর হওয়ার মানে সেই আইনকে রক্ষা করা। আর তার মানে হলো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বহাল রাখা। সেটি বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য হোক কিংবা ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য।” — জোহরান মামদানি (নবনির্বাচিত মেয়র, নিউইয়র্ক সিটি)

নিউইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানির বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তারের ঘোষণা আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং স্থানীয় আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটি গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। গাজায় গণহত্যার অভিযোগে আইসিসির পরোয়ানা আন্তর্জাতিক মঞ্চে নেতানিয়াহুর অবস্থানকে আরও দুর্বল করেছে। যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির সদস্য না হলেও, এই ধরনের কঠোর অবস্থান নিউইয়র্ক শহরকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রক্ষার বিষয়ে একটি শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হিসেবে তুলে ধরবে। এখন অপেক্ষা করার পালা যে, নেতানিয়াহু কি নিউইয়র্কের আমন্ত্রণ গ্রহণ করবেন, এবং যদি করেন, তবে মেয়র মামদানি তার প্রতিশ্রুতি পূরণে বিদ্যমান আইনের মধ্যে থেকে কতদূর যেতে পারেন।

এম আর এম – ২৩০৮,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button