গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ী জরুন এলাকায় একটি শ্রমিক কলোনিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। বুধবার (১৯ নভেম্বর) বিকেলে রুমেল পাঠানের মালিকানাধীন টিনসেড কলোনিতে এই আগুন লাগে। আগুনের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে, মুহূর্তের মধ্যে টিনসেড কলোনির প্রায় ১০০টি কক্ষ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এই কলোনির বেশিরভাগ বাসিন্দা ছিলেন পোশাক শ্রমিক এবং নিম্ন আয়ের মানুষ। আকস্মিক এই অগ্নিকাণ্ডে কেউ হতাহত না হলেও, ঘরগুলোর ভেতরে থাকা সমস্ত আসবাবপত্র, পোশাক এবং শ্রমিকদের বহু কষ্টের সঞ্চয় পুড়ে যাওয়ায় তারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন।
অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ও বিস্তৃতি
ফায়ার সার্ভিস এবং স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, বুধবার বিকেল ৫টার দিকে রুমেল পাঠানের টিনসেড কলোনির একটি কক্ষ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এটি ছিল মূলত শ্রমিকদের ভাড়া দেওয়া একটি বড় কলোনি।
- দ্রুত ছড়িয়ে পড়া: টিনসেড হওয়ায় এবং কাঁচা ঘরগুলোর মধ্যে দূরত্ব কম থাকায়, আগুনের তীব্রতা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং মুহূর্তের মধ্যে আশপাশের সবগুলো কক্ষে ছড়িয়ে পড়ে।
- স্থানীয়দের ব্যর্থ চেষ্টা: আগুন লাগার পরপরই স্থানীয়রা আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আগুনের ভয়াবহতা এবং দাহ্য পদার্থের উপস্থিতির কারণে তারা দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হন।
স্থানীয় বাসিন্দা পলাশ মোল্লা জানান, “খবর শুনে আমরা স্থানীয়রা আগুন নেভানোর চেষ্টা করি। কিন্তু আগুনের ভয়াবহতা এতটাই যে আগুন নেভাতে খুব বেগ পেতে হয়।”
ফায়ার সার্ভিসের অভিযান ও নিয়ন্ত্রণে
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দ্রুত ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়া হয়।
- ৪টি ইউনিট: প্রথমে কোনাবাড়ী মডার্ন ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু করে। পরবর্তীতে পরিস্থিতি সামাল দিতে সারাবো মডার্ন ফায়ার সার্ভিসের আরও দুটি ইউনিট তাদের সাথে যোগ দেয়। মোট চারটি ইউনিট প্রায় ২ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
- চ্যালেঞ্জ: কোনাবাড়ী মডার্ন ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যার হাউস ইন্সপেক্টর মো. সাইফুল ইসলাম জানান, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হওয়ায় এবং রাস্তায় পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের আগুন নেভাতে বেশ বেগ পেতে হয়।
ওয়্যাহাউস ইন্সপেক্টর মো. সাইফুল ইসলাম নিশ্চিত করেছেন, “দীর্ঘ চেষ্টার পর আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে এ ঘটনায় হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।”
ক্ষতিগ্রস্তদের হৃদয়বিদারক বর্ণনা
এই কলোনির বেশিরভাগ ভাড়াটিয়া ছিলেন পোশাক কারখানার শ্রমিক। তাদের সামান্য সঞ্চয়, মূল্যবান কাগজপত্র ও জিনিসপত্র সবই আগুনের গ্রাসে হারিয়ে গেছে।
- পোশাক শ্রমিক শাহ আলম: শাহ আলম নামে এক পোশাক শ্রমিক কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমি অফিস থেকে জানতে পারি বাসায় আগুন লেগেছে। বাসায় আসতে আসতে দেখি সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমার পরনের কাপড় ছাড়া কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।”
- হারানো সঞ্চয়: রহিমা বেগম নামে এক ভাড়াটিয়া জানান, “কয়েক দিন আগে বেতন পাই। বেতনের সব টাকা রুমে ছিল। রাত-দিনে ডিউটি করা টাকা সব মুহূর্তের মধ্যে শেষ হয়ে গেল। আমার তো সব শেষ হয়ে গেলো।”
হতাহত না হলেও, শ্রমিকদের এই সর্বস্ব হারানোর বেদনা তাদের মুখে স্পষ্ট। এই অগ্নিকাণ্ড তাদের জীবনকে এক চরম অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে।
বাড়ির মালিকের বক্তব্য ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ
কলোনিটির মালিক রুমেল পাঠান জানিয়েছেন, টিনসেডের মোট ১০০টি কক্ষ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কোনো কক্ষের কোনো জিনিসপত্রই বের করা সম্ভব হয়নি। তিনি অনুমান করেন, শুধুমাত্র তার কলোনির অবকাঠামোগত ক্ষতিই নয়, বরং ভাড়াটিয়াদের যে পরিমাণ ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ও অর্থ পুড়েছে, তাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
প্রাথমিকভাবে আগুন লাগার সঠিক কারণ এবং ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত পরিমাণ তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। ফায়ার সার্ভিস এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে এই আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।
শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা ও কলোনির কাঠামোগত দুর্বলতা
এই ঘটনাটি আবারও গাজীপুরের শিল্পাঞ্চলগুলোতে শ্রমিকদের আবাসনের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। টিনসেড কলোনি বা শ্রমিক কলোনিগুলো সাধারণত অপরিকল্পিতভাবে এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় গড়ে ওঠে।
- নিরাপত্তাহীনতা: এই ধরনের কলোনিতে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা প্রায় থাকেই না। প্রতিটি কক্ষ অত্যন্ত কাছাকাছি থাকায় আগুন লাগলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
- অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি: শিল্পাঞ্চলে এই ধরনের অগ্নিকাণ্ড প্রায়ই ঘটে। এর কারণ হিসেবে নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সংযোগ, অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং সরু রাস্তাকে চিহ্নিত করা হয়, যার ফলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশে বাধার সৃষ্টি হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, স্থানীয় প্রশাসন এবং শিল্প মালিকদের এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ আবাসনের বিষয়ে আরও কঠোর হতে হবে এবং শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
ক্ষতিগ্রস্ত ভাড়াটিয়ার আকুতি
“কয়েকদিন আগে বেতন পাই। বেতনের সব টাকা রুমে ছিল। রাত-দিনে ডিউটি করা টাকা সব মুহূর্তের মধ্যে শেষ হয়ে গেল। আমার তো সব শেষ হয়ে গেলো।” — রহিমা বেগম (পোশাক শ্রমিক ও ভাড়াটিয়া)
গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১০০টি কক্ষ পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ায় শত শত পোশাক শ্রমিক তাদের জীবনের সমস্ত সঞ্চয় ও আসবাবপত্র হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে চলে এসেছেন। এই ঘটনা শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা এবং শিল্পাঞ্চলের ঘনবসতিপূর্ণ আবাসনের দুর্বলতাকে সামনে এনেছে। ফায়ার সার্ভিস দ্রুত কাজ করলেও, রাস্তার অপ্রতুলতা তাদের কাজে বাধা দিয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ এবং আগুন লাগার প্রকৃত কারণ জানতে তদন্ত চলছে। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের পুনর্বাসন এবং এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কলোনিগুলোতে অগ্নি-নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
এম আর এম – ২৩০৩,Signalbd.com



