আঞ্চলিক

টাঙ্গাইলে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষ: হাসপাতাল-দোকানপাট ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ

Advertisement

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) আসনে দলীয় মনোনয়ন ঘিরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর দুই গ্রুপের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বুধবার (১৯ নভেম্বর) বিকেলে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার আনারস চত্বর এবং সন্ধ্যায় বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এই সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ফলে এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, যার জেরে দুটি বেসরকারি ক্লিনিকসহ বেশ কয়েকটি দোকানপাট ভাঙচুর করা হয় এবং একটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সংঘর্ষে কমপক্ষে তিনজন আহত হয়েছেন বলে স্থানীয় ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে।

সংঘর্ষের মূল কারণ: মনোনয়ন নিয়ে বিরোধ

মধুপুরে বিএনপির এই অভ্যন্তরীণ সংঘাতের মূল কারণ হলো টাঙ্গাইল-১ আসনের দলীয় মনোনয়ন। এই আসনে প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ফকির মাহবুব আনাম স্বপন। অন্যদিকে, দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির আরেক সদস্য মোহাম্মদ আলী মনোনয়ন না পাওয়ায় তার অনুসারীরা ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন এবং মনোনয়ন বাতিলের দাবি জানাচ্ছিলেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বুধবার বিকেলে আনারস চত্বর এলাকায় মোহাম্মদ আলীর সমর্থকরা সমাবেশ করছিলেন। এমন সময় ফকির মাহবুব আনাম স্বপনের সমর্থকরা মিছিল নিয়ে সেখানে প্রবেশ করে। এই পাল্টাপাল্টি অবস্থানে উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং একপর্যায়ে তা সহিংস সংঘর্ষে রূপ নেয়। সন্ধ্যায় এই সংঘর্ষ বাসস্ট্যান্ড এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ে।

সহিংসতার চিত্র: ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ

দুই গ্রুপের সংঘর্ষ চলাকালে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সংঘর্ষকারীরা রাস্তার পাশে থাকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি স্থাপনাগুলোতে হামলা চালায়।

  • হাসপাতাল ভাঙচুর: মধুপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকার লাইফ কেয়ার হাসপাতাল এবং এশিয়া হসপিটাল সহ দুটি বেসরকারি ক্লিনিক ভাঙচুর করা হয়। একটি রাজনৈতিক সংঘর্ষের জেরে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে চরম উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
  • দোকানপাট ভাঙচুর: আনারস চত্বর ও বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সাত থেকে আটটি দোকান এবং বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়। এতে ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতির শিকার হন।
  • অগ্নিসংযোগ ও ক্ষতি: সংঘর্ষের সময় বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয় এবং একটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

সংঘর্ষের সময় শহরের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় এবং সাধারণ মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।

আহত ও ক্ষয়ক্ষতি

সংঘর্ষের ফলে উভয় পক্ষের কমপক্ষে তিনজন আহত হয়েছেন। আহতদের স্থানীয় হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তবে সংঘর্ষের মাত্রা ও ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় আহতের সংখ্যা কম হওয়ায় অনুমান করা হচ্ছে, অধিকাংশ নেতাকর্মী আঘাত এড়াতে সংঘর্ষের স্থান থেকে দ্রুত সরে পড়েন। সংঘর্ষের ফলে শুধুমাত্র সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিই নয়, স্থানীয় ব্যবসায়িক কার্যক্রমেও চরম ব্যাঘাত ঘটে।

জনজীবনে প্রভাব ও যান চলাচল বন্ধ

সন্ধ্যায় বাসস্ট্যান্ডে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার সাথে সাথে পুরো মধুপুর শহরে জনজীবনে স্থবিরতা নেমে আসে। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় এবং আতঙ্কে মানুষজন রাস্তা ছেড়ে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সংঘর্ষের কারণে মধুপুর ত্রিমোহনা হয়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহে (বিশেষ করে ময়মনসিংহ, জামালপুর ও শেরপুর) যাতায়াতকারী সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে সাধারণ যাত্রী ও দূরপাল্লার পরিবহনের যাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হন। দীর্ঘ সময় ধরে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় যানজটেরও সৃষ্টি হয়।

পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর হস্তক্ষেপ

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে মধুপুর থানা পুলিশ এবং পরবর্তীতে স্থানীয় যৌথ বাহিনী (পুলিশ ও সেনা সদস্য) ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। তাদের দ্রুত হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। সংঘর্ষকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে তারা ভাঙচুরের ঘটনা থামান এবং জনমনে শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন।

মধুপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমরানুল কবীর গণমাধ্যমকে জানান, আনারস চত্বরে এক পক্ষের সমাবেশে অন্য পক্ষ প্রবেশ করলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়। বর্তমানে এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করলেও পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তিনি আরও জানান, এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পর্যালোচনা: নির্বাচনের আগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, টাঙ্গাইলের এই সংঘর্ষ বিএনপির অভ্যন্তরে তীব্র মনোনয়ন কোন্দলের বহিঃপ্রকাশ। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে বা পরে বিভিন্ন আসনে বড় দলগুলোর মধ্যে এই ধরনের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের সম্ভাবনা থাকে। একটি দলের এই ধরনের অভ্যন্তরীণ সংঘাত শুধু দলের সাংগঠনিক শৃঙ্খলাকেই ক্ষুণ্ন করে না, বরং সাধারণ মানুষের সামনে দলের ভাবমূর্তিও নষ্ট করে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির জন্য যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা জরুরি, সেখানে এই ধরনের সহিংসতা জনমনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে দ্রুত এই ধরনের কোন্দল নিরসন করে নেতাকর্মীদের মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

ওসি এমরানুল কবীরের বক্তব্য

“আনারস চত্বরে এক পক্ষের সমাবেশে অন্য পক্ষ প্রবেশ করলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়। খবর পেয়ে যৌথ বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে।” — এমরানুল কবীর (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মধুপুর থানা)

টাঙ্গাইল-১ আসনে দলীয় মনোনয়নকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা আবারও দেশের রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের তীব্রতাকে সামনে এনেছে। হাসপাতাল এবং সাধারণ দোকানপাটে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা এই সহিংসতার মাত্রা ও ক্ষতিকর দিকটি ফুটিয়ে তুলেছে। প্রশাসনের দ্রুত হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও এলাকায় এখনো উত্তেজনা বিরাজ করছে। নির্বাচনের পূর্বে দলীয় কোন্দল নিরসনে এবং জনজীবনে শান্তি বজায় রাখতে কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতৃত্বকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। একইসাথে, এই সহিংসতায় যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

এম আর এম – ২৩০২,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button