প্রযুক্তি

বিশ্বের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পুনরায় চালুর পথে জাপান

Advertisement

জাপান আবার পারমাণবিক শক্তির যুগে ফিরতে চলেছে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকা বিশ্বের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র—কাশিওয়াজাকি–কারিওয়া—পুনরায় চালুর অনুমোদন দিতে যাচ্ছে দেশটি। সর্বশেষ প্রতিবেদনগুলো বলছে, চলতি সপ্তাহেই সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

২০১১ সালের ভয়াবহ ফুকুশিমা দাইইচি পারমাণবিক বিপর্যয়ের পর জাপান পারমাণবিক শক্তিকে প্রায় পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবতা দেশটিকে আবার পরমাণু শক্তির দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

কারণ, আমদানি করা জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা শুধু অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করছে না, বরং বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের অস্থিরতা জাপানের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। ফলে দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞা ও জনমতের আশঙ্কাকে পেছনে ফেলে সরকার আবারও পরমাণু শক্তিকে সক্রিয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ফুকুশিমার পর ১৪ বছর: কেন আবার পারমাণবিক শক্তির পথে জাপান?

২০১১ সালের মার্চে সুনামি আঘাত হানার পর ফুকুশিমা দাইইচি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রিয়্যাক্টরে বড় ধরনের গলন দুর্ঘটনা ঘটে। এটি ছিল চেরনোবিলের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক বিপর্যয়।
দুর্ঘটনার পর জনভীতি, নিরাপত্তাহীনতা এবং পরিবেশবাদী আন্দোলনের চাপে জাপান প্রায় সব পারমাণবিক রিয়্যাক্টর বন্ধ করে দেয়।

কিন্তু কয়েক বছর পর জাপান কঠোর নিরাপত্তা মানদণ্ড চালু করে। বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের সহায়তায় প্রতিটি রিয়্যাক্টর নতুনভাবে মূল্যায়ন করা হয়।

এ পর্যন্ত দেশটির পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলে ১৪টি রিয়্যাক্টর পুনরায় চালু হয়েছে।

তারপরও জাপানের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় অংশ এখনও ব্যয়বহুল আমদানি করা তেল, গ্যাস ও কয়লার ওপর নির্ভরশীল।
জ্বালানির দাম বাড়লে সরাসরি ক্ষতির মুখে পড়ে জাপানের শিল্প, ঘরোয়া বিদ্যুৎ বাজার এবং সরকারি বাজেট।

এই বাস্তবতায় জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা বারবার বলেছেন—

“পরমাণু শক্তি পরিষ্কার, স্থিতিশীল ও দীর্ঘমেয়াদে নির্ভরযোগ্য জ্বালানি—কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামাতে এটি অপরিহার্য।”

কাশিওয়াজাকি–কারিওয়া: বিশ্বের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র

নিগাতা প্রদেশে অবস্থিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে সাতটি রিয়্যাক্টর রয়েছে।
একক স্থাপনায় এত বেশি রিয়্যাক্টর বিশ্বের আর কোথাও নেই।

২০০৭ সাল পর্যন্ত এটি জাপানের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় অংশ সরবরাহ করত।

তবে নিরাপত্তা জটিলতা, ভূমিকম্প, এবং ফুকুশিমার পর আইনগত বাধার কারণে রিয়্যাক্টরগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে যায়।

এবার কী হচ্ছে?

কিয়োডো নিউজ ও নিক্কেই–এর প্রতিবেদন বলছে—

  • স্থানীয় গভর্নর হিদেয়ো হনাজুমি শিগগিরই অনুমোদন দিতে চলেছেন
  • প্রথমে একটি রিয়্যাক্টরই চালু করা হবে
  • পর্যায়ক্রমে আরও রিয়্যাক্টর চালুর প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে

অপারেটর প্রতিষ্ঠান টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি (টেপকো)-র জন্য এটি হবে ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পর প্রথম কোনো রিয়্যাক্টর পুনরায় চালুর ঘটনা।

এটি টেপকোর জন্য যেমন বড় অর্জন, তেমনি দেশটির সামগ্রিক জ্বালানি পরিকল্পনার জন্য একটি নতুন মাইলফলক।

স্থানীয় জনগণের উদ্বেগ এখনো আছে

নিগাতা প্রদেশের বাসিন্দাদের একাংশ এখনও নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছে।
ফুকুশিমা দুর্ঘটনা তাদের মনে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে।

সরকার তাই নতুন করে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে—

  • ভূমিকম্প প্রতিরোধ ব্যবস্থা আরও জোরদার
  • রিয়্যাক্টরের চারপাশে বহিস্তর নিরাপত্তা বেষ্টনী
  • তেজস্ক্রিয়তা নিরসনে উন্নত কুলিং সিস্টেম
  • জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় ড্রোন ও এআই প্রযুক্তি
  • জনগণকে নিয়মিত মহড়া ও প্রশিক্ষণ

ফলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান নিরাপত্তা মানদণ্ড বিশ্বের উন্নততমগুলোর একটি।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পারমাণবিক শক্তি কতটা জরুরি?

জাপান ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
এই লক্ষ্য অর্জনে তারা তিন ধরনের জ্বালানিকে সমান গুরুত্ব দিচ্ছে—

  1. পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি—সোলার, উইন্ড, হাইড্রো
  2. হাইড্রোজেন ও অ্যামোনিয়া শক্তি
  3. পারমাণবিক শক্তি

বিশেষজ্ঞদের মতে, পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি দ্রুত বাড়লেও তা এখনও স্থিতিশীল নয়।
সূর্য না থাকলে সোলার বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না, বাতাস না থাকলে উইন্ড টারবাইন বন্ধ থাকে।

কিন্তু পারমাণবিক শক্তি ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ দিতে পারে।

এ কারণে জাপানসহ দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, চীন—সব দেশই আবার পারমাণবিক শক্তিতে জোর দিচ্ছে।

ফুকুশিমা কেন্দ্রের দুর্গত অংশ এখনও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ

যদিও নতুন রিয়্যাক্টর চালুর পথে জাপান এগোচ্ছে, ফুকুশিমার ক্ষত সারতে আরও বহু বছর লাগবে।

তেজস্ক্রিয় ধ্বংসাবশেষ অপসারণ, নষ্ট জ্বালানি সরানো, এবং ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো নিরাপদ করা এখনও জটিল কাজ।

সম্প্রতি যা করা হয়েছে—

  • আগস্টে রোবট পাঠিয়ে গলে যাওয়া জ্বালানির সঠিক অবস্থান নিশ্চিত করা
  • কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে রিয়্যাক্টরের অভ্যন্তর পর্যবেক্ষণ
  • ধ্বংসাবশেষ ধীরে ধীরে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরের প্রস্তুতি

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে ৩০ থেকে ৪০ বছর লেগে যেতে পারে।

জ্বালানি বিশ্লেষকদের মন্তব্য

বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে অস্থিরতা, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা এবং জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি—সব মিলিয়ে আমদানি নির্ভর দেশগুলো বিপাকে পড়েছে।
এ অবস্থায় অনেক বিশ্লেষক বলছেন—

“জাপানের মতো প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশের কাছে পারমাণবিক শক্তি ছাড়া বিকল্প নেই।”

কিছু বিশ্লেষকের মতে, জাপানের এই সিদ্ধান্ত অন্যান্য দেশকেও প্রভাবিত করবে। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, ফিলিপাইন, তুরস্ক এবং ফিনল্যান্ড—সব দেশই পারমাণবিক শক্তি জোরদার করতে চাইছে।

টেপকোর নতুন পরিকল্পনা কী?

টেপকো এখন কেবল রিয়্যাক্টর চালুর দিকেই নজর দিচ্ছে না, পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের নিরাপদ পারমাণবিক রিয়্যাক্টর তৈরির পরিকল্পনাও করছে।

তাদের লক্ষ্য—

  • এডভান্সড লাইট ওয়াটার রিয়্যাক্টর (ALWR) প্রযুক্তি ব্যবহার
  • আরও উচ্চমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা
  • প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বহুগুণ শক্তিশালী ডিজাইন
  • ব্যয় সাশ্রয়ী পরিচালনা

এটি চালু হলে জাপান এশিয়ার মধ্যে আবারও পারমাণবিক প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব ফিরে পাবে।

কানসাই ইলেকট্রিকের ঘোষণা: নতুন রিয়্যাক্টর নির্মাণ শুরু

২০২৫ সালের জুলাইয়ে কানসাই ইলেকট্রিক ঘোষণা দেয়, তারা ফুকুশিমা বিপর্যয়ের পর প্রথমবারের মতো একটি নতুন পারমাণবিক রিয়্যাক্টর নির্মাণের প্রাথমিক পদক্ষেপ নিচ্ছে।
এটি ভবিষ্যতের জ্বালানি পরিকল্পনায় জাপানের আগ্রহ ও আত্মবিশ্বাসকে আরও প্রমাণ করে।

নতুন আশা, নতুন ঝুঁকি, তবুও এগোচ্ছে জাপান

বিশ্বের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পুনরায় চালুর সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সাহসী ও গুরুত্বপূর্ণ।
এটি জাপানের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

তবে ফুকুশিমার অভিজ্ঞতা থেকে সরকার এবং জনগণ যে শিক্ষা পেয়েছে, তা ভুলে গেলে চলবে না।
যথাযথ নিরাপত্তা ও পরিবেশ রক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত হলে পারমাণবিক শক্তি হতে পারে আধুনিক জ্বালানির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস।

জাপান এখন সেই ভারসাম্যই খুঁজছে—
নিরাপত্তা, প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং ভবিষ্যতের জ্বালানি নিরাপত্তা।

MAH – 13888 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button