স্বাস্থ্য

শিশুর হাঁপানি: কারণ, চিকিৎসা ও অভিভাবকদের করণীয়

Advertisement

বাংলাদেশে শিশুদের হাঁপানি বা অ্যাজমা এখন অত্যন্ত পরিচিত এবং দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া একটি দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসতন্ত্রের রোগ। শহরের দূষণ, গ্রামাঞ্চলের ধুলাবালি, অ্যালার্জিজনিত খাবার, বাড়ির ধোঁয়া, আবহাওয়ার আকস্মিক পরিবর্তন এবং জিনগত ইতিহাস—এসব মিলে আজ অনেক শিশুই হাঁপানিতে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ জাতীয় হাঁপানি সমিতির গবেষণা অনুসারে দেশে ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ শিশু কোনো না কোনো মাত্রায় হাঁপানির সমস্যায় ভোগে।

হাঁপানি দীর্ঘমেয়াদি হলেও সঠিক চিকিৎসা, নিয়মিত ফলোআপ এবং অভিভাবকের সচেতন পরিচর্যার মাধ্যমে শিশুকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও সক্রিয় জীবন ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব। শিশুর হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে রোগ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা, এর কারণ, লক্ষণ, পরীক্ষা, চিকিৎসা এবং প্রতিকার—সব কিছু জানা জরুরি।

হাঁপানি কী?

হাঁপানি বা অ্যাজমা হলো ফুসফুসের বায়ুনালিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ ও সংকোচনজনিত একটি সমস্যা। কোনো অ্যালার্জি, ধুলা, সংক্রমণ বা পরিবেশগত উত্তেজনা শ্বাসনালি সংকুচিত করে, যার ফলে বাতাস চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। শ্বাসনালির ভেতরে শ্লেষ্মাও জমে, ফলে শিশুর শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

শিশুর হাঁপানি সাধারণত তিন ধরনের সমস্যার কারণে দেখা দেয়:

  1. শ্বাসনালিতে প্রদাহ সৃষ্টি হয়
  2. বায়ুনালি সরু হয়ে যায়
  3. শ্লেষ্মা জমে নালিতে বাধা তৈরি হয়

এই তিনটি উপাদান মিলেই ঘটে কাশি, শ্বাসকষ্ট, শোঁ–শোঁ শব্দ এবং বুকে চাপ অনুভব।

শিশুর হাঁপানির প্রধান লক্ষণ

শিশুর হাঁপানি একদিনে দেখা দেয় না; ধীরে ধীরে লক্ষণ বাড়তে থাকে। সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণগুলো হলো—

  • শুষ্ক বা ভেজা ধরনের কাশি
  • রাতের বেলা বা ভোরে কাশি বাড়া
  • বুক থেকে শোঁ–শোঁ শব্দ
  • শ্বাসকষ্ট বা হাঁপাহাঁপি
  • সামান্য দৌড়াদৌড়ি বা খেলায় শ্বাসকষ্ট
  • বুক ভারী লাগা
  • দীর্ঘদিন ধরে ফিরে ফিরে কাশি
  • ঘুমের মধ্যে কাশতে থাকা বা কাশতে কাশতে ঘুম ভেঙে যাওয়া

যেসব শিশুর অ্যালার্জি বেশি, তাদের নাক দিয়ে পানি পড়া, চোখ লাল হওয়া, ত্বকে চুলকানি কিংবা মাথার তালুতে আঁশের মতো ঘা দেখা দিতে পারে। পরিবারে বাবা-মা বা ঘনিষ্ঠ কারও হাঁপানি থাকলে শিশুর ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।

কোন কোন কারণে হাঁপানির প্রকোপ বাড়ে?

বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান শিশুর হাঁপানি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সাধারণত নিম্নলিখিত বিষয়গুলো হাঁপানির মূল উত্তেজক:

  • ঘরের ধুলাবালি
  • ফুলের রেণু
  • চুলার ধোঁয়া
  • সিগারেটের ধোঁয়া
  • প্রাণীর লোম বা পশম
  • বিছানার পুরোনো কম্বল
  • তীব্র ঠান্ডা হাওয়া
  • রাসায়নিকযুক্ত খাবার
  • মানসিক চাপ বা পরীক্ষার দুশ্চিন্তা
  • ফসল কাটার মৌসুমের ধুলাবালি

শিশুর পরিবেশ ও দৈনন্দিন অভ্যাসের সঙ্গে এসব উত্তেজক সংযুক্ত থাকলে হাঁপানি বারবার বাড়তে থাকে।

হাঁপানির পরীক্ষা: কোন কোন উপায়ে নির্ণয় করা হয়?

শিশুর হাঁপানি সঠিকভাবে নির্ণয় করাই চিকিৎসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। প্রধানত রোগীর লক্ষণ, ইতিহাস এবং শারীরিক পরীক্ষা দেখে চিকিৎসক প্রাথমিক ধারণা নেন। তবে কিছু নির্ভুল পরীক্ষা রোগটি নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।

নিচে সবচেয়ে প্রচলিত ও নির্ভরযোগ্য তিনটি পরীক্ষার বিবরণ দেওয়া হলো।

১. পিক-ফ্লো মিটার

এই পরীক্ষায় শিশুকে একটি নলের মাধ্যমে জোরে ফুঁ দিতে হয়। এতে ফুসফুসের কর্মক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

বৈশিষ্ট্য:

  • ব্যথাহীন
  • খুব কম খরচ
  • বাড়িতেও ব্যবহারযোগ্য
  • শিশুর শারীরিক সক্ষমতা প্রতিদিন যাচাই করা যায়

শিশুর হাঁপানি কতটা নিয়ন্ত্রণে আছে, তা বুঝতে পিক-ফ্লো মিটার অত্যন্ত উপকারী।

২. FeNO (ফেনো) পরীক্ষা

এটি তুলনামূলক আধুনিক ও অত্যন্ত নির্ভুল পরীক্ষা।

  • পাঁচ বছরের বেশি বয়সী শিশু এই পরীক্ষা করতে পারে
  • নলে ফুঁ দিলেই সফটওয়্যার শ্বাসনালির প্রদাহ শনাক্ত করে
  • হাঁপানি আছে কি না তা দ্রুত বোঝা যায়
  • ব্যথাহীন এবং নিরাপদ

বাংলাদেশে কয়েকটি বিশেষায়িত কেন্দ্রে এটি করা হয়।

৩. স্পাইরোমেট্রি

স্পাইরোমেট্রিতে শিশু জোরে শ্বাস নেয় এবং ছাড়ে। সফটওয়্যার ফুসফুসের কার্যক্ষমতা পরিমাপ করে।

  • ৮–৯ বছরের বেশি শিশুর জন্য উপযোগী
  • নির্ভুল ফলাফল পাওয়া যায়
  • দেশে অনেক হাসপাতালে করা যায়

প্রয়োজনে বিশেষ ক্ষেত্রে মেথাকোলিন চ্যালেঞ্জ টেস্ট, এক্স-রে বা রক্তে অ্যালার্জি পরিমাপ করা হয়।

হাঁপানির চিকিৎসা: প্রথম পছন্দ ইনহেলার

বিশ্বজুড়ে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা শিশুদের হাঁপানির ক্ষেত্রে মুখে খাওয়ার ওষুধ বা নেবুলাইজেশনের চেয়ে ইনহেলারকে সবচেয়ে কার্যকর ও নিরাপদ চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এর পেছনে যুক্তি রয়েছে।

ইনহেলার ব্যবহারের কারণ:

  1. কম ডোজে সবচেয়ে বেশি কার্যকারিতা
  2. ওষুধ সরাসরি ফুসফুসে কাজ করে
  3. শিশুর উচ্চতা বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি নেই
  4. ইনহেলার ব্যবহারে হাঁপানি দীর্ঘমেয়াদে নিয়ন্ত্রণে থাকে
  5. অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রয়োজন কমে যায়
  6. খরচ অনেক কম

যেসব শিশু ইনহেলার ব্যবহার করতে পারে না, তাদের ক্ষেত্রে নেবুলাইজেশন ব্যবহার করা হয়। গুরুতর অবস্থায় স্বল্পমেয়াদি মুখে খাওয়ার স্টেরয়েড প্রয়োগ করা হয়। তবে দীর্ঘমেয়াদে মুখে খাওয়ার স্টেরয়েড শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

ইনহেলার অবশ্যই স্পেসারসহ ব্যবহারে অভ্যস্ত করতে হবে। প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্য কর্মীর কাছ থেকে শিশুকে ইনহেলার ব্যবহারের নিয়ম শেখানো জরুরি।

খাদ্যাভ্যাসে কী করবেন?

১. বুকের দুধ

  • প্রথম ছয় মাস শুধুই বুকের দুধ
  • দুই বছর পর্যন্ত বুকের দুধ চালিয়ে যেতে হবে

২. খাবারে অ্যালার্জি পরীক্ষা

একটি খাবার একদিন দিন।
যে খাবারে সমস্যা হয় সেটা বাদ দিন।
সমস্যা না হলে অল্প করে খেতে দিন।

অ্যালার্জিযুক্ত সাধারণ কিছু খাবার—
গরুর দুধ, গরুর মাংস, ইলিশ, চিংড়ি, বেগুন, পুঁইশাক, হাঁসের ডিম ইত্যাদি।

৩. কৃত্রিম রঙ ও কেমিক্যালযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন

  • প্যাকেট জুস
  • চিপস
  • চকলেট
  • রঙযুক্ত মিষ্টি
  • কেমিক্যাল দেওয়া ফল (মাল্টা, আঙুর)

৪. দেশি ফল বেশি দিন

আম, জাম, পেয়ারা, লেবু, কমলা, আমড়া, পেঁপে, লটকন—এগুলোতে ভিটামিন সি থাকে, যা হাঁপানির প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।

৫. প্রতিদিন রোদে ১৫ মিনিট

ভিটামিন ডি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে যা করবেন

  • শিশুর ঘর ঝাড়ু দেওয়ার সময় শিশুকে দূরে রাখুন
  • মশার কয়েল বা স্প্রে ব্যবহার করবেন না
  • মশারি ব্যবহার বাড়িয়ে দিন
  • ধূমপান ও পরোক্ষ ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ
  • কম্বলের পরিবর্তে কাভারসহ লেপ ব্যবহার করুন
  • নরম খেলনা, কার্পেট, কুশন এড়িয়ে চলুন
  • ধুলাবালির মৌসুমে মুখোশ ব্যবহার করুন
  • স্ক্রিন টাইম কমিয়ে বাইরে খেলতে উৎসাহ দিন

ভুল ও বিপজ্জনক চিকিৎসা থেকে সাবধান

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বা পথের ধারে অনেক সময় হাঁপানির “টোটকা” চিকিৎসা দেওয়া হয়। এসব ওষুধে থাকে—

  • নিষিদ্ধ স্টেরয়েড
  • অতিরিক্ত ব্রংকোডাইলেটর
  • কেমিক্যালযুক্ত ভেষজ উপাদান

এসব ওষুধ সাময়িক স্বস্তি দিলেও ভবিষ্যতে মারাত্মক ক্ষতি করে। তাই শিশুর হাঁপানি চিকিৎসা কখনোই অপ্রশিক্ষিত ব্যক্তির কাছে নেওয়া যাবে না।

ফ্লু ভ্যাকসিন দেওয়া জরুরি

যেসব শিশুর হাঁপানি অনিয়ন্ত্রিত, তাদের বছরে একবার ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকা নিতে হবে। এতে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ কমে এবং হাঁপানি অ্যাটাকের ঝুঁকি হ্রাস পায়।

অভিভাবকের করণীয়

  • শিশুকে ইনহেলার ব্যবহারের সঠিক নিয়ম শেখান
  • স্পেসার ব্যবহার বাধ্যতামূলক
  • ইনহেলার নেওয়ার পর কুলি করাতে হবে
  • শিশুর ঘর শুকনো ও পরিষ্কার রাখুন
  • নিয়মিত ফলোআপ করুন
  • স্কুলে শিক্ষকের কাছে জানিয়ে রাখুন

হাঁপানি কোনো ভয়াবহ বা অযোগ্য রোগ নয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি কিন্তু নিয়ন্ত্রণযোগ্য অবস্থা। সঠিক চিকিৎসা, নিয়মিত ইনহেলার ব্যবহার, পরিবেশ পরিষ্কার রাখা, অ্যালার্জি শনাক্ত করা এবং শিশুর খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হাঁপানি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। অভিভাবকের সচেতনতা এবং নিয়মিত চিকিৎসা অনুসরণই শিশুদের জন্য নিরাপদ ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারে।

MAH – 13884 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button