মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মার্কিন মধ্যস্থতায় একে একে উপসাগরীয় কয়েকটি দেশ ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করলেও সবচেয়ে বড় আঞ্চলিক শক্তি সৌদি আরব এখনো তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। তবে এবার সৌদি যুবরাজ ও প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) জানিয়েছেন—ইসরাইলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপনে রিয়াদ আগ্রহী, তবে তার আগে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটি স্পষ্ট, কার্যকর এবং বাস্তবমুখী রূপরেখা প্রয়োজন।
মঙ্গলবার ওয়াশিংটন ডিসির ওভাল অফিসে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে সৌদি যুবরাজ এই বার্তা দেন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ডসহ বিভিন্ন মাধ্যম এ তথ্য জানিয়েছে।
আব্রাহাম চুক্তিতে যোগদানের শর্ত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র
বৈঠকে সৌদি যুবরাজ বলেন,
“আমরা আব্রাহাম চুক্তির অংশ হতে চাই। কিন্তু এর আগে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের জন্য একটি স্পষ্ট পথনকশা জরুরি। আমরা চাই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হোক।”
এ বক্তব্য মধ্যপ্রাচ্যে নতুন আলোচনা তৈরি করেছে, কারণ সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনিদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে থেকেছে। ২০০২ সালের আরব পিস ইনিশিয়েটিভ–এও রিয়াদ স্পষ্ট করে জানিয়েছিল—ইসরাইল যদি ১৯৬৭ সালের সীমানায় ফিরে যায় এবং পূর্ব জেরুসালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়, তাহলেই আরব দেশগুলো তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে।
সেই অবস্থান থেকে সৌদি আরব আজও সরেনি বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
ইসরাইল–ফিলিস্তিন শান্তির জন্য সৌদি আরবের অবস্থান
ওভাল অফিসে আলোচনার সময় যুবরাজ আরও বলেন—
“আমরা ইসরাইলি জনগণের জন্য শান্তি চাই। একইভাবে ফিলিস্তিনিদের জন্যও শান্তি চাই। আমরা চাই, তারা সবাই মধ্যপ্রাচ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করুক।”
তিনি আরও যোগ করেন,
“আমরা দ্রুত এমন পরিবেশ তৈরি করতে চাই, যেখানে দুই পক্ষের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়। এর জন্য আমরা যে কোনো সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।”
সৌদির এই অবস্থানকে অনেক বিশ্লেষক আঞ্চলিক কূটনীতির গুরুত্বপূর্ণ মোড় বলে মনে করছেন।
ইসরাইলের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান
অন্যদিকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বহু বছর ধরেই দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের বিরোধিতা করে আসছেন। তার রাজনৈতিক জোটে থাকা চরমপন্থী ডানপন্থী দলগুলো শুধু ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেই নয়, বরং দখলকৃত পশ্চিম তীরকে ধীরে ধীরে ইসরাইলের সঙ্গে যুক্ত করতে চায়।
ফলে সৌদি আরব যে স্পষ্ট শর্ত ঘোষণা করেছে, তা বাস্তবে কতটা সম্ভব—তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
কেন সৌদি আরবের এই সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ?
বিশ্লেষকদের মতে, সৌদি আরবের ভূমিকাই ইসরাইল–ফিলিস্তিন সংকটে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। কারণ—
১. সৌদি আরব ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্বস্থানীয় দেশ
মদিনা–মক্কার অভিভাবক রাষ্ট্র হিসেবে সৌদি আরবের সিদ্ধান্ত মুসলিম বিশ্বের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। রিয়াদ যদি ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে, তাহলে অন্যান্য আরব ও মুসলিম দেশও তা অনুসরণ করতে পারে।
২. মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সৌদি–ইসরাইল সহযোগিতা নতুন শক্তির ভারসাম্য তৈরি করবে
ইরান, তুরস্ক, কাতারের মতো দেশগুলো এই অঞ্চলে তাদের প্রভাব বাড়াচ্ছে। সৌদি–ইসরাইল সম্পর্ক উন্নয়ন হলে মধ্যপ্রাচ্যে ভূ-রাজনৈতিক পালাবদল হবে।
৩. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সৌদি আরব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক মিত্র। তাই মার্কিন প্রেসিডেন্টদের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা—ইসরাইল–সৌদি সম্পর্ক স্বাভাবিক করা।
বাইডেন প্রশাসন, ট্রাম্প প্রশাসন—even উভয় দলই একই লক্ষ্য অনুসরণ করেছে।
ট্রাম্প ও সৌদি সম্পর্ক: অতীত ও বর্তমান
২০১৭–২০২০ মেয়াদে ট্রাম্প প্রশাসন সৌদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। তেল বাজার, অস্ত্র চুক্তি, এবং ইরানবিরোধী জোট গঠনে দুই দেশের সহযোগিতা শীর্ষে পৌঁছেছিল।
সেই সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় আবারও ওভাল অফিসে সৌদি যুবরাজ–ট্রাম্প বৈঠক মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন জল্পনা সৃষ্টি করেছে। কিছু বিশ্লেষক মনে করেন—
- ট্রাম্প পুনরায় মধ্যস্থতা শুরু করতে পারেন
- সৌদি–ইসরাইল আলোচনার গতি বাড়তে পারে
- মার্কিন–সৌদি সম্পর্ক ‘স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ’-এ আরও একধাপ এগোতে পারে
এদিকে ট্রাম্প পুনরায় উল্লেখ করেছেন যে খাসোগি হত্যাকাণ্ড বিষয়ে যুবরাজ কিছু জানতেন না বলে তিনি বিশ্বাস করেন—যা সৌদি নেতৃত্বের জন্য কূটনৈতিকভাবে স্বস্তির।
ফিলিস্তিন প্রশ্নেই মূল জটিলতা
সৌদি আরব ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি দীর্ঘদিন ধরে তুলে আসছে। এর কারণ—
- আরব বিশ্বের জনমানস ফিলিস্তিনের পক্ষে
- ইসলামি বিশ্বের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা
- জেরুসালেম প্রশ্ন—যা আরব দুনিয়ার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
- ফিলিস্তিন ছাড়া ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক করা সৌদি শাসকদের জন্য রাজনৈতিক ঝুঁকিপূর্ণ
যদিও সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো, সুদান আব্রাহাম চুক্তিতে যোগ দিয়েছে, সৌদি আরব এখনো বলছে—
“ফিলিস্তিন প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখে কোনো সম্পর্ক সম্ভব নয়।”
যুক্তরাষ্ট্রে ১ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ: সৌদির অর্থনৈতিক শক্তি
বৈঠকের সময় যুবরাজ জানিয়েছেন—সৌদি আরব আগামী কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ১ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।
এটি হবে—
- প্রযুক্তি
- জ্বালানি
- অবকাঠামো
- স্বাস্থ্যসেবা
- প্রতিরক্ষা
- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
- ও নবায়নযোগ্য শক্তি
খাতে ব্যাপক সহযোগিতার অংশ।
এই বিনিয়োগ শুধু সৌদি–মার্কিন সম্পর্কই মজবুত করবে না, বরং মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি ও বৈশ্বিক মার্কেটেও বড় প্রভাব ফেলবে।
বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
- ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ চলমান থাকা অবস্থায় সৌদির এই ঘোষণা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
- এটি যুদ্ধবিরতি ও ভবিষ্যৎ শান্তি আলোচনায় চাপ সৃষ্টি করবে।
- সৌদি আরব চায়—মধ্যপ্রাচ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের পথে এগিয়ে যাক, যা যুদ্ধ ও সংঘাতের কারণে সম্ভব হচ্ছে না।
মধ্যপ্রাচ্য গবেষক ড. রবার্ট মেসন বলেন—
“সৌদি আরবের শর্ত খুবই বাস্তবভিত্তিক। কারণ দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান ছাড়া এই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি সম্ভব নয়।”
ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া
ইসরাইলের নেতানিয়াহুর কাছ থেকে এখনো সরাসরি কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য না এলেও ইসরাইলি ডানপন্থী রাজনীতিকরা সৌদির শর্তকে ‘অবাস্তব’ বলে মন্তব্য করেছেন।
তবে ইসরাইলি নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন—
- সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে ইসরাইল শেষ পর্যন্ত কোনো না কোনো ছাড় দিতে বাধ্য হতে পারে
- যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে আলোচনায় আনতে চাপ বাড়াবে
- ফিলিস্তিন বিষয়ে অন্তত একটি ‘সফট প্রমিজ’ দিতে হতে পারে
মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ কোন পথে?
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই যদি সৌদি–ইসরাইল সম্পর্কের মূল শর্ত হয়, তবে ভবিষ্যতে কয়েকটি বিষয় ঘটতে পারে—
● দখলকৃত পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ থামাতে চাপ
● গাজায় মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি
● ভবিষ্যৎ “রোডম্যাপ টু প্যালেস্টাইন”
● আরব লীগ ও ওআইসির সম্মিলিত ভূমিকা বাড়ানো
● ইরান–হিজবুল্লাহ প্রভাব পুনর্মূল্যায়ন
যা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি–রাজনীতিকে সম্পূর্ণ নতুন দিকে নিয়ে যেতে পারে।
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সাম্প্রতিক ঘোষণাটি শুধু একটি কূটনৈতিক মন্তব্য নয়—বরং মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে একটি বড় সিগন্যাল।
তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন—
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হলে সৌদি আরব কখনোই আব্রাহাম চুক্তিতে যোগ দেবে না।
এই অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে সামনে এনে নতুন ভাবে আলোচনার দিক তৈরি করেছে।
এখন দেখার বিষয়—ইসরাইল কতটা নমনীয় হয়, এবং যুক্তরাষ্ট্র এ ইস্যুতে কতটা চাপ প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রতিষ্ঠায় সৌদি আরবের এই অবস্থান নিঃসন্দেহে ভবিষ্যৎ কূটনীতির বড় আলোচ্য হয়ে থাকবে।
MAH – 13873 I Signalbd.com



