ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী এবং কট্টরপন্থী ইহুদি নেতা ইতামার বেন-গভির ফিলিস্তিন পরিস্থিতি নিয়ে আবারও চরম উসকানিমূলক মন্তব্য করেছেন। তিনি হুমকি দিয়ে বলেছেন, জাতিসংঘ যদি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে এগোয়, তবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের খুঁজে খুঁজে গুপ্তহত্যা করার নির্দেশ দেওয়া উচিত হবে। বেন-গভির তার মন্তব্যে শীর্ষ পিএ কর্মকর্তাদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সোমবার (১৭ নভেম্বর) তার ওৎজমা ইয়েহুদিত দলের এক সভায় বক্তৃতাকালে তিনি এই হুমকি দেন বলে একাধিক আন্তর্জাতিক ও ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। তার এই মন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র নিন্দার জন্ম দিয়েছে।
বেন-গভিরের হুমকির বিস্তারিত:
জেরুজালেম পোস্ট এবং আল জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, বেন-গভির তার বক্তৃতায় ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ার তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, “যদি তারা ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসী রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে এবং জাতিসংঘ একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বেছে বেছে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়াই উচিত হবে। কারণ, সবদিক থেকেই তারা সন্ত্রাসী।”
বেন-গভির এখানেই থামেননি। তিনি আরও দম্ভের সঙ্গে বলেন, যদি জাতিসংঘের ভোটে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণা সামনে এগোয়, তবে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে গ্রেপ্তার করা উচিত। তার জন্য কেৎজিয়ত কারাগারে একটি বিশেষ কক্ষ প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। ইসরায়েলের একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীর কাছ থেকে ফিলিস্তিনি নেতৃত্বকে লক্ষ্য করে এমন সরাসরি হত্যার হুমকি ভূ-রাজনৈতিক অঙ্গনে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
ফিলিস্তিনের তীব্র প্রতিক্রিয়া এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান
বেন-গভিরের এই চরম মন্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে আলাদাভাবে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের বিবৃতিতে ইসরায়েলের কর্মকর্তাদের এ ধরনের মন্তব্যকে ‘পদ্ধতিগত উসকানি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই ধরনের মন্তব্যের জন্য বেন-গভিরকে জবাবদিহির আওতায় আনতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছে।
ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বেন-গভিরের এই ধরনের মন্তব্যের দায়ভার ইসরায়েল সরকারকে নিতে হবে। তারা এই ধরনের উগ্রপন্থী বক্তব্যকে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এই মন্তব্যের মাধ্যমে ইসরায়েলি সরকারের চরমপন্থী মনোভাবের প্রকাশ দেখতে পাচ্ছে।
হুমকির পূর্বপটভূমি: জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবনা
বেন-গভিরের এই হুমকি এমন এক সময়ে এলো, যখন গাজা যুদ্ধ শেষ করার জন্য প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত পরিকল্পনাকে সমর্থন জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের করা একটি খসড়া প্রস্তাবের পক্ষে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ভোট দিয়েছে। এই প্রস্তাবে গাজা উপত্যকার নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা বাহিনী গঠনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সংস্কার কর্মসূচি শেষ করলে এবং গাজা পুনর্গঠন কাজ এগিয়ে গেলে ‘ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্র গঠনে একটি বিশ্বাসযোগ্য পথ তৈরিতে’ জাতিসংঘ সমর্থন দেবে। ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ থাকায় এই প্রস্তাব নিয়ে ইসরায়েলের কট্টরপন্থী অংশ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটল বেন-গভিরের মন্তব্যে।
ইসরায়েলি সরকারের দ্বিচারিতা ও কট্টরপন্থীদের অবস্থান
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে নিরাপত্তা সমন্বয় করে কাজ করে, তবুও ইসরায়েলি নেতারা পিএর নেতৃত্বে কোনো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ঘোর আপত্তি জানিয়ে রেখেছে।
বেন-গভির এবং নেতানিয়াহু সরকারের জোটে থাকা অতি ডানপন্থী দলগুলো দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ অবস্থানে রয়েছে যে, কোনো সার্বভৌম ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে দেওয়া হবে না। অর্থমন্ত্রী বেনজালেল স্মোট্রিচ, যিনি কার্যত অধিকৃত পশ্চিম তীরের গভর্নরের দায়িত্বে আছেন, তিনিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন যাতে তারা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে। স্মোট্রিচ অধিকৃত পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের ভূখণ্ডের সঙ্গে একত্র করে ফেলতে চাইছেন।
অতীতের উসকানিমূলক মন্তব্য ও সমালোচনার তীর
ইতামার বেন-গভির এর আগেও ফিলিস্তিনিদের নিয়ে একাধিক উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। গত শনিবারই তিনি ফিলিস্তিনি বলে কোনো জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব নেই বলে দাবি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “ফিলিস্তিনি জনগণ বলে আসলে কিছু নেই। ফিলিস্তিনিদের বরং ইসরায়েলের ভূমিতে আরব দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসীদের সমষ্টি বলে অভিহিত করা যায়, যারা সব জায়গায় সন্ত্রাস, হত্যাকাণ্ড ও হত্যাযজ্ঞের বীজ বপন করে।”
এই উগ্র ইহুদি নেতা ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমি ছেড়ে স্বেচ্ছায় অন্য কোথাও চলে যাওয়ার (ভোলান্টারি মাইগ্রেশন) প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। সমালোচকেরা ফিলিস্তিনিদের স্বেচ্ছায় ভূমি ছাড়ার প্রস্তাবকে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের সুপরিকল্পিত জাতিহত্যার অংশ বলে বর্ণনা করেছেন। তার এই ধরনের মন্তব্য ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন
আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইতামার বেন-গভিরের প্রকাশ্যে শত্রু রাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের হত্যার নির্দেশ দেওয়ার হুমকি আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। এই ধরনের মন্তব্য যুদ্ধাপরাধের উসকানির শামিল হতে পারে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এই ধরনের মন্তব্যের বিষয়ে তদন্ত শুরু করতে পারে। এছাড়া, জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের ফিলিস্তিনি নেতাদের গুপ্তহত্যার হুমকি মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলেছে। এটি ইসরায়েল সরকারের চরমপন্থী মনোভাব এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে তাদের অনমনীয় অবস্থানেরই প্রতিফলন। তার এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক আইন এবং শান্তির প্রতি সরাসরি হুমকি। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে জাতিসংঘ ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর জোরালো প্রতিক্রিয়া শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য অপরিহার্য।
এম আর এম – ২২৯৭,Signalbd.com



