কার্যক্রমে নিষিদ্ধ থাকা রাজনৈতিক সংগঠনের মিছিলে ‘অর্থায়নের অভিযোগে’ দায়ের করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ডেপুটি রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ লাভলু মোল্লাহ শিশিরকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাসুম মিয়া শুনানি শেষে তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এই ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। শাহবাগ থানা পুলিশ মঙ্গলবার দুপুরে লাভলু মোল্লাহকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানোর কথা নিশ্চিত করে। এই মামলায় তার বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের কার্যক্রমে মদদ দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।
গ্রেপ্তারের কারণ ও পুলিশের বক্তব্য
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. খালিদ মনসুর জানিয়েছেন, কিছুদিন আগে পুলিশ বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা দায়ের করেছিল। সেই মামলায় ডেপুটি রেজিস্ট্রার লাভলু মোল্লাহর বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের মিছিলে অর্থ যোগানের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওসি মনসুর বলেন, “লাভলু মোল্লাহ শিশিরের বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের মিছিলে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে, যা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় আসে। এই মামলায় আমরা তাকে গ্রেপ্তার করেছি।”
পুলিশের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়েছে যে, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রায়ের পর লাভলু মোল্লাহ তার ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইলে শেখ হাসিনার ছবিযুক্ত একটি ফটোকার্ড পোস্ট করেন। সেখানে তিনি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, আই ডোন্ট কেয়ার’ লেখাটি ব্যবহার করেন। এই পোস্টকে কেন্দ্র করে সোমবার মধ্যরাতে কিছু শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা তার বাসায় যান এবং সেখানে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতেই তাকে রাতে হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল বলে পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান।
মামলা এবং অভিযোগের বিবরণ
মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, গত ৩১ মে ভোর সাড়ে ৬টার দিকে শাহবাগের পরীবাগ এলাকায় কার্যক্রমে নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের উদ্দেশ্যে মিছিল করে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মিছিলকারীরা পালিয়ে যায়।
এই ঘটনায় ১ জুন শাহবাগ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করেন এসআই কামাল উদ্দিন মিয়া। এই মামলার আসামিদের মধ্যে মুহাম্মদ লাভলু মোল্লাহ শিশিরও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, এই মিছিলে যারা অংশ নিয়েছিল, লাভলু মোল্লাহ তাদের আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন, যা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমকে উৎসাহিত করার শামিল।
আদালতে শুনানি ও জামিন নামঞ্জুর
গ্রেপ্তারের পর মঙ্গলবার লাভলু মোল্লাহ শিশিরকে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার এসআই আলামিন আদালতে তাকে কারাগারে আটক রাখার জন্য আবেদন জানান।
অন্যদিকে, লাভলু মোল্লাহর পক্ষে আইনজীবী জি.এম কাওসার-উল ইসলাম সোহেলসহ কয়েকজন আইনজীবী জামিন চেয়ে আবেদন করেন। তারা আদালতে যুক্তি দেন যে, লাভলু মোল্লাহ একজন সরকারি কর্মকর্তা এবং তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তবে উভয় পক্ষের শুনানি শেষে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাসুম মিয়া তার জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। প্রসিকিউশনের এসআই জিন্নাত আলী জানান, আদালত তার জামিন আবেদন খারিজ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তার আইনজীবী জি.এম কাওসার-উল ইসলাম সোহেল আরও জানান, রিমান্ডের কোনো আবেদন না থাকায় তাকে এজলাসে তোলা হয়নি।
রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার লাভলু মোল্লাহর গ্রেপ্তারের ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ বলছেন, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে তিনি এই পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, নিষিদ্ধ সংগঠনের কার্যক্রমে আর্থিক সহায়তা দেওয়া একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার কাজ হতে পারে না।
ছাত্র সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে অবশ্য কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়নি। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে সরকারবিরোধী কার্যক্রমে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, এবং এই ঘটনা তারই একটি অংশ। এই গ্রেপ্তারের ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের বার্তা দিয়েছে যে, নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের প্রতি কোনো ধরনের সমর্থন বা অর্থায়ন আইনত শাস্তিযোগ্য।
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের প্রয়োগ ও বিশ্লেষণ
বিশ্লেষকদের মতে, লাভলু মোল্লাহর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলা দায়ের এবং জামিন নামঞ্জুরের ঘটনাটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় রাজনৈতিক কার্যক্রমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণের ইঙ্গিত দেয়। সন্ত্রাসবিরোধী আইন সাধারণত সহিংসতা বা রাষ্ট্রবিরোধী বড় আকারের ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। এক্ষেত্রে মিছিলে অর্থ যোগানের অভিযোগ এনে এই আইনের প্রয়োগ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, মামলার তদন্তে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে লাভলু মোল্লাহর কঠিন শাস্তি হতে পারে। এই ধরনের মামলায় জামিন পাওয়া কঠিন, কারণ রাষ্ট্রপক্ষ সাধারণত এই ধরনের অপরাধকে গুরুতর হিসেবে বিবেচনা করে।
“কিছুদিন আগে পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে, যেখানে লাভলু মোল্লাহর বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের মিছিলে অর্থ যোগানের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আমরা এই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করেছি।” — মো. খালিদ মনসুর (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, শাহবাগ থানা)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ লাভলু মোল্লাহ শিশিরের কারাগারে পাঠানো রাজনৈতিক পরিস্থিতির জটিলতাকেই তুলে ধরে। নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের মিছিলে অর্থায়নের অভিযোগে দায়ের করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় তার জামিন নামঞ্জুর হওয়া প্রমাণ করে যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই ধরনের কার্যকলাপের প্রতি কঠোর অবস্থান বজায় রেখেছে। এই মামলার তদন্তের মাধ্যমে ভবিষ্যতে আরও তথ্য উঠে আসবে এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তার ভাগ্য নির্ধারিত হবে।
এম আর এম – ২২৯৬,Signalbd.com



