বিশ্ব

অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত আনওয়ারুল, আজাদ কাশ্মীরের নতুন প্রধানমন্ত্রী রাজা ফয়সাল

Advertisement

পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ জম্মু ও কাশ্মীরের (এজেকে) রাজনীতিতে আবারও নাটকীয় পালাবদল ঘটেছে। সোমবার (১৭ নভেম্বর) রাজ্যের আইনসভায় (লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি) অনুষ্ঠিত এক অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী আনওয়ারুল হক। একই দিনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আইনপ্রণেতার সমর্থনে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা রাজা ফয়সাল মমতাজ রাঠোর। এর মাধ্যমে রাজা ফয়সাল আজাদ জম্মু ও কাশ্মীরের ১৬তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। এই দ্রুত পরিবর্তন অঞ্চলটির রাজনৈতিক সমীকরণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবং তা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

অনাস্থা ভোটের বিস্তারিত চিত্র

সোমবার স্থানীয় সময় বিকেল ৩টায় স্পিকার চৌধুরী লতিফ আকবরের সভাপতিত্বে আজাদ জম্মু ও কাশ্মীরের আইনসভার অধিবেশন শুরু হয়। পিপিপির আইনপ্রণেতা কাসিম মাজিদ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী আনওয়ারুল হকের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর স্পিকার চৌধুরী লতিফ আকবর প্রস্তাবটির ওপর ভোটের আহ্বান জানান।

মোট ৫৩ সদস্যের বিধানসভায় ভোটাভুটির সময় ৪৪ জন আইনপ্রণেতা উপস্থিত ছিলেন। এই ভোটে প্রস্তাবের সমর্থনে মোট ৩৬ জন সদস্য ভোট দেন। এই ৩৬ ভোটের মধ্যে পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন)-এর আটজন সদস্যের সমর্থন ছিল গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)-এর মাত্র দুই আইনপ্রণেতা খাজা ফারুক আহমেদ এবং আব্দুল কাইয়ুম নিয়াজি প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ আইনপ্রণেতার সমর্থন হারানোর কারণে চৌধুরী আনওয়ারুল হক প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হন।

ক্ষমতাচ্যুতি পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ ও ওয়াকআউট

অনাস্থা ভোটে ক্ষমতা হারানোর পর চৌধুরী আনওয়ারুল হক আইনসভায় সংক্ষিপ্ত বক্তব্য প্রদান করেন। এরপর তিনি তার পাঁচজন সহকর্মী—মীর আকবর, আজহার সাদিক, সাবিহা সিদ্দিক এবং ইমতিয়াজ বেগমসহ—অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করেন। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর এই ওয়াকআউট রাজনৈতিক অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এদিকে, মুসলিম কনফারেন্স (এমসি) সভাপতি সরদার আতিক আহমেদ ভোটদানে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। জম্মু ও কাশ্মীর পিপলস পার্টি (জেকেপিপিপি)-এর সদস্যরা, যেমন হাসান ইব্রাহিম, আনসার আবদালি এবং মুহাম্মদ ইকবাল, আইনসভার অধিবেশনে অনুপস্থিত ছিলেন। এই আইনপ্রণেতাদের ভোটদানে বিরত থাকা বা অনুপস্থিত থাকা নতুন সরকার গঠনে পিপিপি ও পিএমএল-এনের জোটকে আরও সহজ করে দিয়েছে।

নতুন প্রধানমন্ত্রী রাজা ফয়সাল মমতাজ রাঠোরের বিজয়

চৌধুরী আনওয়ারুল হক ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আইনসভায় নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। পিপিপি এবং পিএমএল-এন জোটের সমর্থিত প্রার্থী রাজা ফয়সাল মমতাজ রাঠোর সহজেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করে আজাদ জম্মু ও কাশ্মীরের ১৬তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। পিপিপি দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলে নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে আসছিল, এবং এই বিজয় তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম ভাষণে রাজা ফয়সাল মমতাজ রাঠোর তার সরকারকে সমর্থন দেওয়ায় প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি এবং পিপিপি চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারিকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, দলীয় নেতৃত্বের পক্ষ থেকে তার ওপর অর্পিত আস্থার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

নতুন সরকারের অগ্রাধিকার ও চ্যালেঞ্জ

নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী রাজা ফয়সাল মমতাজ রাঠোর তার সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারগুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আজাদ জম্মু ও কাশ্মীরের উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা তার সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হবে। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং উন্নয়ন কার্যক্রমে স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠাই তার সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, রাঠোরকে তার জোট শরিক পিএমএল-এনের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি এবং ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হবে। এছাড়া, ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতি এবং সামগ্রিকভাবে কাশ্মীর ইস্যুর দিকে আন্তর্জাতিক মনোযোগ ধরে রাখা নতুন সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বেকারত্ব হ্রাস এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মনোযোগ দেওয়া রাঠোর সরকারের জন্য অপরিহার্য।

রাজনৈতিক জোটের মেরুকরণ এবং ভবিষ্যৎ প্রভাব

আজাদ জম্মু ও কাশ্মীরের এই পরিবর্তন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজনীতির জোটের মেরুকরণকেও প্রতিফলিত করে। পিপিপি এবং পিএমএল-এনের জোটবদ্ধভাবে আনওয়ারুল হককে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং রাজা ফয়সালকে নির্বাচিত করা কেন্দ্রীয় সরকারের ঐক্যের ইঙ্গিত বহন করে। এটি দেখায় যে, জাতীয় পর্যায়ে প্রধান দলগুলো আঞ্চলিক পর্যায়েও একে অপরের সঙ্গে কৌশলগতভাবে কাজ করতে প্রস্তুত।

অন্যদিকে, ক্ষমতাচ্যুত পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) এর অবস্থান দুর্বল হলো। যদিও পিটিআই-এর আইনপ্রণেতাদের মধ্যে ভোট নিয়ে বিভেদ ছিল, এই অনাস্থা ভোট অঞ্চলটিতে তাদের রাজনৈতিক আধিপত্য ক্ষুণ্ণ করেছে। এই পালাবদল কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞ মতামত

আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. কামরান সিদ্দিকী মনে করেন, “আজাদ কাশ্মীরে এই ঘন ঘন ক্ষমতার রদবদল স্থানীয় প্রশাসন ও উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে জনগণের প্রত্যাশিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। নতুন প্রধানমন্ত্রীর জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে কেবল জোট টিকিয়ে রাখা নয়, বরং দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের রোডম্যাপ তৈরি করা।”

অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে আজাদ জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষমতা হস্তান্তর অঞ্চলটির রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। চৌধুরী আনওয়ারুল হকের ক্ষমতাচ্যুতি এবং রাজা ফয়সাল মমতাজ রাঠোরের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়া পিপিপি এবং পিএমএল-এনের সমন্বিত রাজনৈতিক শক্তির বহিঃপ্রকাশ। নতুন প্রধানমন্ত্রীর সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক—রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনা, উন্নয়ন নিশ্চিত করা এবং কাশ্মীরের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা। এই পালাবদল ভবিষ্যতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলে, সেদিকেই এখন সবার নজর।

এম আর এম – ২২৯০,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button