দিনাজপুরের বিরামপুরে নবান্ন উৎসব উপলক্ষে নতুন শাড়ি কিনে দেওয়াকে কেন্দ্র করে পারিবারিক কলহের জেরে এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার সকালে স্বামীর সাথে বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে রেহেনা বেগম (৫০) নামে এক স্ত্রী তার হাতে থাকা বসার পিঁড়ি দিয়ে আঘাত করলে ঘটনাস্থলেই স্বামী হাফিজুল ইসলাম (৬৫) লুটিয়ে পড়েন। পরে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এই ঘটনা বিরামপুর উপজেলার দিওড় ইউনিয়নের কুঁচিয়া মোড় এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। স্থানীয়রা ও পুলিশ জানিয়েছে, একটি সামান্য পারিবারিক আবদার কীভাবে ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে, এটি তারই করুণ দৃষ্টান্ত। এই ঘটনায় পুলিশ দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে অভিযুক্ত স্ত্রীকে আটক করেছে এবং আইনগত প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ: যেভাবে ঘটল মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড
বিরামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মমতাজুল হক বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, নিহত হাফিজুল ইসলাম ছিলেন কুঁচিয়া মোড় এলাকার মৃত আব্দুস সামাদের ছেলে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার সকালের দিকে নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে রেহেনা বেগম স্বামীর কাছে একটি নতুন শাড়ি কিনে দেওয়ার জন্য আবদার করেন। এই আবদারকে কেন্দ্র করেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শুরু হয় তীব্র তর্ক-বিতর্ক। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তাদের মধ্যে প্রায়শই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ছোটখাটো ঝগড়া লেগে থাকত, তবে আজকের দিনের কলহটি চরম রূপ নেয়। একপর্যায়ে, প্রচণ্ড ক্ষোভের বশে স্ত্রী রেহেনা বেগম হাতের কাছে থাকা কাঠের তৈরি বসার পিঁড়িটি তুলে নিয়ে স্বামী হাফিজুল ইসলামের মাথায় সজোরে আঘাত করেন। আঘাতের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে, তিনি তাৎক্ষণিকভাবে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং মাথা থেকে রক্তক্ষরণ হতে থাকে।
পুলিশের পদক্ষেপ ও অভিযুক্তকে আটক
স্থানীয়রা গুরুতর আহত অবস্থায় হাফিজুল ইসলামকে দ্রুত উদ্ধার করে বিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে পৌঁছানোর পর পরই কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। খবর পেয়ে বিরামপুর থানা পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায় এবং ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা খতিয়ে দেখে। এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে নিহত হাফিজুল ইসলামের স্ত্রী রেহেনা বেগমকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে।
বিরামপুর থানার ওসি মমতাজুল হক বলেন, “ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের ফোর্স পাঠানো হয়েছে। অভিযুক্ত রেহেনা বেগমকে আটক করা হয়েছে এবং হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত পিঁড়িটি জব্দ করা হয়েছে। নিহতের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে, এটি ক্ষণিকের উত্তেজনার ফলে সৃষ্ট একটি হত্যাকাণ্ড, যার নেপথ্যে দীর্ঘদিনের পারিবারিক কলহ ছিল।
পারিবারিক কলহ ও সামাজিক প্রেক্ষাপট
স্থানীয় প্রতিবেশীরা জানান, হাফিজুল ইসলাম এবং রেহেনা বেগমের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরে মনোমালিন্য চলছিল। তবে, নবান্ন উপলক্ষে শাড়ি কিনে দেওয়ার মতো একটি সাধারণ আবদারকে কেন্দ্র করে এমন ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে, তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। এই ঘটনা গ্রামীণ সমাজে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের জটিলতা এবং ছোটখাটো বিষয়ে ধৈর্যের অভাবের একটি করুণ চিত্র তুলে ধরেছে। নবান্ন বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব, যেখানে নতুন ফসল ঘরে তোলার আনন্দ উদ্যাপিত হয় এবং নতুন পোশাক পরা একটি সাধারণ রেওয়াজ। সেই উৎসবের আবদারকে কেন্দ্র করে জীবনাবসানের ঘটনা পরিবার ও সমাজে গভীর শোক ও বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।
আইনগত প্রক্রিয়া ও পরবর্তী পদক্ষেপ
পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে আসার পর আইন অনুযায়ী রেহেনা বেগমের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ধারায় হত্যা মামলা দায়ের করা হবে। মামলাটি দায়ের করবেন নিহতের পরিবারের সদস্যরা বা পুলিশ নিজে বাদী হয়ে। মামলা দায়েরের পর অভিযুক্তকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হবে। এই মামলায় রেহেনা বেগমের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে পুলিশ তদন্তে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। পারিবারিক সহিংসতার এমন ঘটনায় আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক বিশ্লেষণ
সমাজবিজ্ঞানী ও মনস্তত্ত্ববিদরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনাগুলো মূলত দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ, আর্থিক অনটন এবং সম্পর্কে যোগাযোগের অভাবের ফল। একটি ছোট বিষয়কে কেন্দ্র করে মুহূর্তের মধ্যে চরম ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং মানুষ আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। পারিবারিক বন্ধন ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর জোর দেওয়া এবং যেকোনো সমস্যায় আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খোঁজা অপরিহার্য। নবান্নের মতো একটি উৎসবের দিনে এমন নৃশংস ঘটনা পারিবারিক কাঠামোর দুর্বলতা এবং গ্রামীণ সমাজে সহিংসতা বৃদ্ধির প্রবণতার দিকে ইঙ্গিত করে। এই ধরনের ঘটনা রোধে শুধু আইন নয়, সামাজিক সচেতনতা এবং পারিবারিক কাউন্সিলিং-এরও প্রয়োজন রয়েছে।
“ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের ফোর্স পাঠানো হয়েছে। অভিযুক্ত রেহেনা বেগমকে আটক করা হয়েছে এবং মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য দিনাজপুর মর্গে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” — মমতাজুল হক (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বিরামপুর থানা)
দিনাজপুরের বিরামপুরে নবান্ন উপলক্ষে শাড়ি কিনে না দেওয়ায় স্ত্রীর হাতে স্বামীর নিহত হওয়ার ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এটি পারিবারিক সম্পর্কের জটিলতা এবং সামান্য কলহের ভয়াবহ পরিণতির এক মর্মান্তিক উদাহরণ। এই ঘটনা শুধু আইনগত সমস্যাই নয়, বরং সামাজিক অস্থিরতা ও পারিবারিক সহিংসতার গভীর শিকড়ের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পুলিশ দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে অভিযুক্তকে আটক করেছে এবং আইনগত প্রক্রিয়া চলছে। এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেজন্য সামাজিক সচেতনতা এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধৈর্যের অনুশীলন জরুরি।
এম আর এম – ২২৮৮,Signalbd.com



