আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী নির্বাচন) বিপুল সংখ্যক তরুণ ভোটার তাদের প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চলেছেন, যা একটি রেকর্ড সংখ্যা ছুঁয়ে যাবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, বিগত স্বৈরশাসনের অধীনে অনুষ্ঠিত কারচুপির নির্বাচনে ভোট দিতে না পারা এই তরুণ প্রজন্ম এবার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে, যা জাতির জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত সৃষ্টি করবে। মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নেদারল্যান্ডসের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিষয়ক ভাইস-মিনিস্টার প্যাস্কেল গ্রোটেনহুইসের সঙ্গে এক সৌজন্য সাক্ষাতের সময় তিনি এই মন্তব্য করেন। গণতান্ত্রিক রূপান্তর এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা এ সময় আন্তর্জাতিক মহলের কাছে তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। এই নির্বাচনকে তিনি কেবল সরকার গঠনের নির্বাচন নয়, বরং গণ-অভ্যুত্থানকে পূর্ণতা দেওয়ার নির্বাচন এবং ‘দেশ রক্ষার নির্বাচন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
নির্বাচনে তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাবর্তনের তাৎপর্য
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতে, আসন্ন নির্বাচন কেবল একটি রুটিন নির্বাচন নয়, এটি একটি গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী নির্বাচন। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, গত ১৫ বছর ধরে যারা ভোট দেওয়ার উপযুক্ত বয়স হওয়া সত্ত্বেও ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি, সেই বিপুল সংখ্যক তরুণ এবার ভোটকেন্দ্রে আসবেন। এই তরুণরাই মূলত গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে ঢাকা এবং অন্যান্য শহরের দেয়াল গ্রাফিতি ও চিত্রকর্মে ভরে তুলেছিলেন, যা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। তাদের এই অংশগ্রহণ কেবল ভোটের সংখ্যা বৃদ্ধি করবে না, বরং নির্বাচনের বৈধতা, গ্রহণযোগ্যতা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করবে। তরুণদের প্রথম ভোট প্রদান নিশ্চিত করা একটি উৎসবমুখর এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার ওপর নির্ভর করছে, যার জন্য সরকার এবং নির্বাচন কমিশন উভয়ই প্রস্তুতি নিচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বার্তা
নেদারল্যান্ডসের ভাইস-মিনিস্টারের সাথে সাক্ষাতকালে প্রধান উপদেষ্টা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্বাচন প্রস্তুতির বিষয়ে বিস্তারিত জানান। তিনি আন্তর্জাতিক মহলের কাছে স্পষ্ট করেন যে, সরকার ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য এবং উৎসবমুখর নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তিনি স্বীকার করেন যে এত অল্প সময়ে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়াটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। বৈঠকে দুই নেতা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে একমত হন এবং কৃষি, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি এবং যুব উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা করেন। বিশেষত, যুব ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য একটি সোশ্যাল বিজনেস ফান্ড তৈরির সম্ভাব্যতা নিয়ে তাদের মধ্যে আগ্রহ দেখা যায়। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা ইতোমধ্যে এই নির্বাচনের বিষয়ে গভীর উৎসাহ দেখাচ্ছেন বলে প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেন।
ভোটার তালিকা এবং নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রকাশিত চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুযায়ী, দেশে মোট ভোটারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই তালিকায় প্রথমবারের মতো ভোট দেবেন এমন তরুণদের সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণ। নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যেই একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবহার, পর্যাপ্ত সংখ্যক ভোটকেন্দ্র স্থাপন এবং প্রতিটি কেন্দ্রে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সদ্য পদায়ন করা জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) উদ্দেশেও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, যেখানে তিনি শতভাগ সততা, নিরপেক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসকেরা এই নির্বাচনের মাধ্যমে জাতির নবজন্মের ধাত্রীর ভূমিকায় থাকবেন।
বিরোধীদের নির্বাচন থেকে দূরে থাকা ও ব্যাখ্যা
প্রধান উপদেষ্টা বৈঠকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নিতে না পারার কারণও ব্যাখ্যা করেন। তিনি জানান, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং নির্বাচন কমিশন তাদের নিবন্ধন স্থগিত করেছে। এই কারণে তারা আসন্ন সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। এই পরিস্থিতিতে, নির্বাচনটি মূলত অন্যান্য দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অংশগ্রহণে একটি বহুদলীয় প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা তরুণ ভোটারদের জন্য আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নির্বাচনকে ঘিরে সকল পক্ষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।
ডাচ মন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি
নেদারল্যান্ডসের ভাইস-মিনিস্টার প্যাস্কেল গ্রোটেনহুইস বাংলাদেশের নির্বাচন প্রস্তুতির ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার এত অল্প সময়ে ভোটের জন্য প্রস্তুত হয়েছে, যা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। তিনি বাংলাদেশের নতুন শ্রম আইনেরও প্রশংসা করে বলেন, এই আইন ডাচ ও ইউরোপীয় বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সহায়ক হবে। ডাচ মন্ত্রী জানান, নেদারল্যান্ডস বাংলাদেশের বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই করার পরিকল্পনা করছে এবং শিগগিরই এটি সই হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। তিনি মন্তব্য করেন, “৫০ বছর ধরে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডস উন্নয়ন অংশীদার ছিল। এখন আমরা এই সম্পর্ককে রাজনীতি, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগে একটি সম-অংশীদারিত্বে রূপান্তরিত করতে চাই।”
নির্বাচনের ভবিষ্যৎ এবং জাতীয় প্রত্যাশা
এই নির্বাচনকে সফল করাকে প্রধান উপদেষ্টা গণ-অভ্যুত্থানের প্রতি জাতির প্রতিশ্রুতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এটি কেবল একটি সরকার গঠনের নির্বাচন নয়, বরং গণভোট যুক্ত হওয়ায় এটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ একটি লড়াই। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই নির্বাচন একটি বিরাট অভিযান, যেখানে জাতিকে অবশ্যই জিততে হবে স্বাধীন জাতি হিসেবে টিকে থাকতে হলে। তরুণ ভোটারদের এই রেকর্ড অংশগ্রহণ জাতির কাছে এক নতুন আশার বার্তা নিয়ে এসেছে। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়েই জাতির জন্য নির্ধারিত হবে শতাব্দীর গতিপথ। নির্বাচনকে ঘিরে সকল উদ্বেগ কাটিয়ে একটি নতুন গণতান্ত্রিক যুগের সূচনা হবে বলে জাতীয়ভাবে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য একটি সন্ধিক্ষণ হতে চলেছে, যেখানে রেকর্ড সংখ্যক তরুণ ভোটার তাদের প্রথম ভোট দেবেন। এটি কেবল নির্বাচনের ফলাফলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং গণতন্ত্রের প্রতি নতুন প্রজন্মের বিশ্বাস এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের পরিচায়ক। সরকার একটি সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এবং আন্তর্জাতিক মহলও এই প্রক্রিয়ায় গভীর আগ্রহ দেখাচ্ছে। এই নির্বাচন গণ-অভ্যুত্থানকে পূর্ণতা দিয়ে জাতির জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে—এমনটাই আশা করা হচ্ছে।
এম আর এম – ২২৮৬,Signalbd.com



