বাংলাদেশ-ভারতের ফুটবল লড়াই সবসময়ই উত্তেজনা, আবেগ এবং দর্শকপ্রিয়তার প্রতীক। এশিয়ার এই দুই ফুটবল শক্তির মধ্যে প্রতিযোগিতা কেবল খেলাধুলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি দর্শক, সমর্থক এবং জাতীয় গৌরবের অনুভূতিও জাগায়। ফিফা র্যাংকিংয়ের সাম্প্রতিক ফলাফলে দুই দলের ব্যবধান এখনও বড় — ভারত ১৩৬তম স্থানে, আর বাংলাদেশ ১৮৩তম। অর্থাৎ দুই দলের মধ্যে ৪৭ ধাপের ফারাক রয়েছে। তবুও, বাংলাদেশের ফুটবলাররা নিজেদের আত্মবিশ্বাসে ও গতিবেগে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত।
২০২৫ সালের এই লড়াই বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। কারণ, তারা দেশের মাটিতে ভারতের বিরুদ্ধে নতুন এক ইতিহাস গড়তে চায়। শিলংয়ে এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে ভারতের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে বাংলাদেশের ফুটবলাররা প্রমাণ করেছেন যে তারা বড় চ্যালেঞ্জ নিতে পারে। এবার ঢাকায় ঘরের মাঠে ভারতের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই তাদের জন্য কঠিন পরীক্ষা, কিন্তু প্রস্তুতি শতভাগ।
বাংলাদেশের ভারতের বিরুদ্ধে ইতিহাস: শুরু থেকেই উত্তেজনা
দুই দেশের ফুটবল দ্বৈরথের ইতিহাস বহু পুরনো। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ফুটবলে প্রথমবার ভারতের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই হয় ১৯৭৮ সালে ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে। সেই ম্যাচ বাংলাদেশের জন্য হতাশাজনক ছিল। ভারত ৩-০ গোলে জিতেছিল। গোল করেছিলেন বিদেশ বোস, হারজিন্দর সিং এবং জাভিয়ের পিয়াস। পরের এশিয়ান গেমসেও বাংলাদেশ ভারতের কাছে হেরে যায়।
১৯৯৭ সালের কাঠমান্ডুর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপেও গ্রুপ পর্বের ম্যাচে বড় ব্যবধানে হেরেছিল বাংলাদেশ। ওই ম্যাচে ৭৪ মিনিট পর্যন্ত গোলপোস্ট রক্ষা করতে পারলেও শেষের মিনিটগুলোতে আইএম বিজয়ন এবং বাইচুং ভুটিয়ার গোল বাংলাদেশের আক্ষেপ আরও বাড়িয়েছিল।
তবে, এই দীর্ঘ ইতিহাসের মাঝে বাংলাদেশের জন্যও স্মরণীয় বিজয় এসেছে।
স্মরণীয় দিন: বাংলাদেশ জিতেছিল ভারতের বিপক্ষে
১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর কলম্বো সাফ গেমস বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে স্বর্ণযুগের একটি দিন। সুগাথাদাসা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ ২-১ গোলে ভারতকে হারিয়েছিল। দুটি গোল করেছিলেন রুমি রিজভী কলিম (২০ এবং ৭৫ মিনিটে)। যদিও ৮৮ মিনিটে গডফ্রে পেরেইরা ভারতের ব্যবধান কমিয়েছিলেন, বাংলাদেশের প্রথম বিজয় স্থায়ী হয়। এই দিনটি বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের কাছে আজও অনন্য স্মৃতি।
এগিয়ে থেকেও হতাশা: ড্রয়ের গল্প
ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ প্রায়শই এগিয়ে থেকেও হতাশার স্বাদ পেয়েছে।
- ২০০৩ সালের কলকাতা সল্ট লেক স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ এগিয়ে থেকেও ১-১ ড্র করতে হয়েছিল।
- ১৯৮৫ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে কলকাতায় আশীষ ভদ্রের গোলে এগিয়ে থাকলেও বাংলাদেশ ২-১ হেরে যায়।
যদি হার না হলেও, এমন ড্র বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের জন্য মানসিক চাপ তৈরি করেছিল।
উত্তপ্ত মাঠ, উত্তেজনাপূর্ণ গ্যালারি
বাংলাদেশ-ভারতের ম্যাচে উত্তেজনা কেবল মাঠেই সীমাবদ্ধ থাকে না, দর্শকও উত্তপ্ত থাকে।
- ১৯৮৫ ঢাকার সাফ ফাইনাল এমনই একটি উদাহরণ। ম্যাচ কিছুক্ষণ বন্ধ করতে হয়েছিল, কারণ গ্যালারিতে উত্তেজনা এতটাই প্রবল ছিল।
- ২০০৫ করাচি সাফেও গ্যালারি উত্তপ্ত ছিল। দর্শকদের শান্ত করতে ভারতের কোচ পিকে ব্যানার্জি এবং বাংলাদেশের কোচ আন্দ্রেস ক্রুসিয়ানি মাঠে দাঁড়িয়ে হস্তক্ষেপ করেছিলেন।
টাইব্রেকারে হতাশা: বাংলাদেশের জয় অপেক্ষা
টাইব্রেকার অর্থাৎ পেনাল্টি শুটআউটে ভারত বাংলাদেশের জন্য প্রায়শই দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
- ১৯৮৫ ঢাকা সাফ ফাইনাল: নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময় শেষে ১-১ ড্র। টাইব্রেকারে ৪-১ গোলে হার।
- ১৯৯৫ কলম্বো সার্ক গোল্ডকাপ সেমিফাইনাল: নির্ধারিত সময় শেষ হয় গোলশূন্য ড্র। টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হার।
যেখানে ভারত জিতেছে, বাংলাদেশ হতাশার মুখোমুখি হয়েছে।
সাম্প্রতিক ফলাফল ও বর্তমান ফর্ম
বাংলাদেশ শেষবার ভারতকে ২০০৩ সালে ঢাকায় সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে হারিয়েছিল। খেলায় ড্র থাকার পর অতিরিক্ত সময়ের সপ্তম মিনিটে মতিউর রহমান মুন্নার গোল বাংলাদেশের জন্য জয়ের পথে নিয়ে যায়।
ভারত সর্বশেষ বাংলাদেশকে ২০২১ সালে দোহায় বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ২-০ গোলে হারিয়েছিল। এরপর দুই দল আরও দুইবার মুখোমুখি হয়েছে, কিন্তু প্রত্যেকবার ফলাফল হয়েছে ড্র।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ফুটবলাররা আত্মবিশ্বাসী। হামজা চৌধুরীর নেতৃত্বে দল ঘরের মাঠে শক্তভাবে লড়াই করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে ভারতের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র প্রমাণ করেছে যে বাংলাদেশ বড় চ্যালেঞ্জ নিতে পারে।
মাঠে নতুন প্রতিযোগিতা, আশা ও প্রত্যাশা
২০২৫ সালের এই লড়াই বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য নতুন এক অধ্যায় শুরু করতে পারে।
- ঘরের মাঠে জয় উদ্দীপনা আনতে পারে।
- বাংলাদেশের ফুটবলারদের মানসিক শক্তি পরীক্ষা হবে।
- ভারতের বিপক্ষে লড়াই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি নয়, বরং নতুন সাফল্যের সম্ভাবনা তৈরি করবে।
ফুটবলপ্রেমীরা আশা করছে, এই ম্যাচ কেবল একটি খেলা নয়, বরং বাংলাদেশের ফুটবলের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
বাংলাদেশ-ভারতের ফুটবল দ্বৈরথ ইতিহাস, উত্তেজনা, হাসি-কান্না, জয়-পরাজয় এবং দর্শকদের আবেগের সমন্বয়। ঢাকায় ২০২৫ সালের এই ম্যাচটি কেবল তিন পয়েন্টের লড়াই নয়, এটি বাংলাদেশের জন্য আত্মবিশ্বাস, একতা এবং ফুটবলের নতুন দিগন্তের প্রতীক। ইতিহাসের স্মৃতি, সাম্প্রতিক ফলাফল এবং খেলোয়াড়দের দৃঢ়সংকল্প মিলিয়ে বাংলাদেশের ফুটবলাররা ভারতকে ঘরের মাঠে চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রস্তুত।
বাংলাদেশ-ভারতের লড়াই আবারও স্মৃতির পাতায় নতুন একটি অধ্যায় লিখতে চলেছে। ফুটবলপ্রেমীদের জন্য এই ম্যাচের উত্তেজনা এবং প্রত্যাশা সীমাহীন।
MAH – 13857 I Signalbd.com



