বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত সময়টি ছিল অত্যন্ত জটিল ও সংকটপূর্ণ। দেশ স্বাধীন হলেও, রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড, এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য লড়াই চলছিল। এই সময়কালে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত ঘটনা হলো তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড।
তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তন এবং জিয়াউর রহমানের মৃত্যু একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত।
মুজিব আমলের পরিপ্রেক্ষিত
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন। তবে এই সময় দেশ সামরিক অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এবং নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।
- ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে জহির রায়হান হত্যার মাধ্যমে দেশে গুমের সংস্কৃতি শুরু হয়।
- ২ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে সিরাজ সিকদারকে গ্রেপ্তার করে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে হত্যা করা হয়।
- ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ কৃত্রিম দুর্ভিক্ষে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, যা প্রশাসনিক ব্যর্থতা, লুটপাট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ঘটে।
- ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, বাকশাল পতনের পর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড দেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।
মুজিব আমলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ছিল সীমিত। বিশ্বের অনেক দেশই স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমতা নিয়ে সন্দিহান ছিল। বিশেষ করে ভারত কেন্দ্রিক ভিজিল্যান্স এবং দিল্লি থেকে পরিচালিত নীতির কারণে দেশে একটি স্বাধীন ও স্থিতিশীল পররাষ্ট্রনীতি গড়ে তোলা জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।
জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক ভুমিকা
বাকশাল পতনের পর খোন্দকার মোশতাক আহমদ এবং জিয়াউর রহমান নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরানো হয়।
- তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেশকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি অর্জনে সাহায্য করেন।
- জিয়াউর রহমান অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। মুজিব আমলে সীমাহীন লুটপাট ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে পরিচিত ছিল।
- জিয়ার উদ্যোগে দুইটি বড় অর্থনৈতিক সিংহদ্বার খোলা হয়:
- শ্রমশক্তি রপ্তানি
- তৈরি পোশাক শিল্প (RMG)
এই দুটি ক্ষেত্র পরবর্তীতে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হিসেবে পরিচিত হয়।
শেখ হাসিনার বিদেশী নির্বাসন
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সময়, শেখ হাসিনা, তার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া এবং বোন শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। তারা পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আশ্রয়ে নয়াদিল্লিতে বসবাস করেন।
এই নির্বাসনের সময়কাল ১৯৮১ সাল পর্যন্ত চলেছিল। ১৯৮১ সালে, দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
দেশে প্রত্যাবর্তন ও হত্যার ষড়যন্ত্র
১৭ মে ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে ফিরে আসেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সরকার তার দেশে প্রবেশে বাধা দেননি। বলা হয়, জিয়ার ‘গ্রিন সিগন্যাল’েই দেশে ফেরেন হাসিনা।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তার আগমনের মাত্র ১২ দিন পরই, ৩০ মে ১৯৮১, চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে নিহত হন জিয়াউর রহমান।
- হত্যাকাণ্ডে বহিঃশক্তির সহায়তা ছিল।
- আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং দেশীয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব জিয়াকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল।
- হত্যার পরিকল্পনা শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়েই করা হয়।
বিবিসি সাক্ষাৎকারের প্রেক্ষাপট
বিবিসির সাংবাদিক সিরাজুর রহমান তার গ্রন্থ এক জীবন এক ইতিহাস-এ শেখ হাসিনার প্রথম লন্ডন সফরের ঘটনা উল্লেখ করেছেন।
- সেখানে শেখ হাসিনা বলেন, “রাজনীতি তার ভালো লাগে না, রাজনীতিকে তিনি ঘৃণা করেন। ওরা আমার পিতাকে হত্যা করেছে, আমার মাতাকে হত্যা করেছে, আমার ভাইদের হত্যা করেছে, আমি প্রতিশোধ নিতে চাই।”
- এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক যাত্রা শুধুই প্রতিশোধ নয়, বরং দেশের জন্য স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করার লড়াই।
আন্তর্জাতিক ও আভ্যন্তরীণ প্রভাব
জিয়াউর রহমানের হত্যা শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক হত্যা নয়, এটি দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
- দেশকে গণতান্ত্রিক ও ইসলামী বিশ্বের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়া আরও জোরদার হয়।
- পররাষ্ট্রনীতিতে স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়, বিশেষ করে ভারতের প্রভাবমুক্ত নীতি গ্রহণ হয়।
- অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত হয়।
বর্তমান প্রেক্ষাপট ও স্মৃতি
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, শেখ হাসিনা আবারো দিল্লিতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। নতুন রাজনৈতিক সুবাতাস বইলেও, ইতিহাসের এই অধ্যায়—হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তনের ১৩তম দিনে জিয়াউর রহমানের হত্যা—কোনোভাবে ভুলে যাওয়ার নয়।
- ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরি।
- ভবিষ্যতের জন্য প্রশ্ন থাকে, “আবার যদি কোনো নেত্রী বা নেতা দেশে প্রত্যাবর্তন করেন, তাহলে সেই ১৩তম দিন কেমন হবে?”
- কারা লক্ষ্যবস্তু হতে পারেন, তা নিয়েও ভাবনার অবকাশ আছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস শেখায় যে, স্বাধীনতা শুধু যুদ্ধ বা স্বাধীনতার ঘোষণা নয়; এটি একটি চলমান সংগ্রাম। জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক যাত্রা এবং দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরের সঙ্গে জড়িত।
আজকের বাংলাদেশে রাজনৈতিক সচেতনতা, ইতিহাসের শিক্ষণীয় দিকগুলো উপলব্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মানুষ যাতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষা করতে পারে এবং রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মতো ইতিহাস পুনরায় ঘটতে না পারে, তার জন্য শিক্ষার বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের খবর ও বিশ্লেষণ নিয়মিত পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন।
MAH – 13850 I Signalbd.com



