রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর এখন শুধু একটি ভবন নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে পরিচিত। সোমবার (১৭ নভেম্বর, ২০২৫) দুপুরে জুলাই স্মৃতি পরিষদ ও জুলাই আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীরা এই জায়গাকে একটি উন্মুক্ত খেলার মাঠে রূপান্তরের দাবিতে বুলডোজার নিয়ে জড়ো হন।
ঢাকা কলেজ এলাকা থেকে শুরু হওয়া মিছিলটি শেষে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে পৌঁছায়। এতে অংশগ্রহণ করেন জুলাই আন্দোলনের যোদ্ধারা, শহীদ পরিবারের সদস্যরা, এবং বিভিন্ন বয়সের ছাত্র-জনতা।
ধানমন্ডি ৩২-এর ইতিহাস ও গুরুত্ব
ধানমন্ডি ৩২ শুধু একটি বাড়ি নয়, এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। ১৯৬০-এর দশক থেকে এটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য পরিচিত। এ বাড়ি থেকে দেশের বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলন ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা চালু হয়েছিল।
১৯৬২ সালে এ বাড়ি থেকে এন্টি-আয়ুব আন্দোলনের পরিকল্পনা শুরু হয়। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনের মূল নকশা এ বাড়িতেই প্রস্তুত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রাকসন্ধ্যায় এটি কৌশলগত কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণার প্রস্তুতিও এ বাড়ি থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। দুঃখজনকভাবে, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের নিহত হওয়ার ঘটনাও এই বাড়িতে সংঘটিত হয়।
স্বাধীনতার পর এটি স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘরে রূপান্তরিত হলেও, অনেকেই মনে করেন, এটি এখন জনগণের জন্য প্রায় অপ্রয়োজনীয় প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মিছিল ও জনতার দাবি
জুলাই স্মৃতি পরিষদের আহ্বায়ক নাহিদ হাসান বলেন, “ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে একটি উন্মুক্ত খেলার মাঠ চাই। আজ আমরা সবাই একত্রিত হয়েছি — জুলাই আন্দোলনের যোদ্ধারা, শহীদ পরিবার এবং সাধারণ মানুষ।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের দাবি, বাংলাদেশে কোনো ধরনের স্বৈরাচারী শাসন আর থাকবে না। ধানমন্ডি ৩২ ছিল ছাত্র ও সাধারণ মানুষের ওপর হামলার কেন্দ্র। এখানেই নীলনকশা তৈরি করা হতো। তাই এই বাড়িটিকে গুঁড়িয়ে একটি উন্মুক্ত, জনকল্যাণমুখী স্থান তৈরি করা হবে।”
জুলাই যোদ্ধা সাব্বির বলেন, “ধানমন্ডি ৩২ শুধু একটি বাড়ি নয়, এটি ছাত্র-জনতার ওপর সহিংসতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। আমরা আর এটি দেখতে চাই না। এই বাড়ি ভেঙে সাধারণ মানুষের জন্য একটি মুক্ত, নিরাপদ খেলার মাঠ তৈরি করা আমাদের লক্ষ্য।”
শিক্ষার্থী হাবিসুর, যারা বুলডোজারের অংশ, বলেন, “ঢাকায় শিশু পার্ক ও খেলার মাঠের সংখ্যা খুবই কম। ধানমন্ডি ৩২ ফ্যাসিবাদের প্রতীক। আমরা চাই, এটি ভেঙে একটি উন্মুক্ত পার্ক হোক। রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যারিকেড ভেঙে বুলডোজার নিয়ে এগিয়ে যাব।”
নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও পরিস্থিতি
পুলিশ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে নিরাপত্তা জোরদার করেছে। মিছিল ও কর্মসূচি সুষ্ঠু রাখার জন্য পুলিশ উপস্থিত রয়েছে, তবে আন্দোলনকারীরা জানান, রায় ঘোষণার পর তারা প্রস্তুত।
নাহিদ হাসান বলেন, “পুলিশ আমাদের আটকায়নি। আমরা স্বেচ্ছায় অপেক্ষা করছি। রায় ঘোষণার পরই আমরা আমাদের কর্মসূচি শুরু করবো।”
প্রেক্ষাপট ও রাজনৈতিক প্রভাব
এই দাবি কেবল খেলার মাঠ চাওয়ার জন্য নয়। এটি একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতীক। ধানমন্ডি ৩২-এর ইতিহাস এবং এখানে সংঘটিত রাজনৈতিক ঘটনার কারণে এটি দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনার বিষয়।
২০২৫ সালের বুলডোজার মিছিলের অংশ হিসেবে জনতা এ বাড়ি ভাঙার দাবি তুলেছে। তাদের মতে, এটি ইতিহাসের একটি বিরাট প্রতীক হিসেবে থাকবে না, বরং জনগণের জন্য একটি মুক্ত স্থান হবে। সরকারের পক্ষ থেকে এই ধরনের কর্মসূচির বিষয়ে সতর্কতা এবং আইনগত প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে।
বিশ্লেষ
১. স্মৃতিবদ্ধ ও রাজনৈতিক গুরুত্ব: ধানমন্ডি ৩২ একটি জাতীয় স্মৃতিসৌধ এবং বঙ্গবন্ধুর বাড়ি হিসেবে পরিচিত।
২. জন আন্দোলন: জুলাই আন্দোলন থেকে শুরু করে ছাত্র-জনতার বুলডোজার মিছিল — এটি শুধু রাজনৈতিক প্রত্যাখ্যান নয়, নতুন ইতিহাসের সূচনা।
৩. নিরাপত্তা ও ঝুঁকি: বুলডোজার এবং ভাঙচুর কার্যক্রমে আইনগত ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে।
৪. ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: ধানমন্ডি ৩২ একটি খেলার মাঠে পরিণত হলে, এটি কেবল পার্ক নয়, ইতিহাস ও সামাজিক মিলনের জায়গা হবে।
৫. স্মৃতি সংরক্ষণ: যদিও পুরাতন ভবন ভাঙা হয়, তবে ইতিহাস এবং স্মৃতি জনতার মনে থাকবে।
ধানমন্ডি ৩২-এর ভবন বর্তমানে নতুন ইতিহাসের অংশ হতে চলেছে। ছাত্র-জনতার দাবি অনুযায়ী এটি খেলার মাঠ ও পার্কে পরিণত হলে, এটি কেবল একটি জনকল্যাণমূলক স্থান নয়, বরং রাজনৈতিক স্মৃতি এবং সামাজিক ঐক্যের প্রতীক হবে।
এই আন্দোলন ইতিহাসের সঙ্গে সংঘর্ষ এবং ভবিষ্যতের সঙ্গে সংলাপের মিল। ধানমন্ডি ৩২ যদি সত্যিই উন্মুক্ত খেলার মাঠে রূপান্তরিত হয়, তাহলে এটি জনতার আশা, স্মৃতি, এবং স্বপ্নের প্রতীক হিসেবে স্থায়ী হবে।
MAH – 13847 I Signalbd.com



