বাংলাদেশ

তিন দিন পর মারা গেলেন স্কুলবাসের দগ্ধ চালক

Advertisement

মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলায় একটি মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটেছে। হলি চাইল্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি স্কুলবাসে দুর্বৃত্তদের আগুন ধরানোর ঘটনায় দগ্ধ হয়েছিলেন চালক পারভেজ খান (৪৫)। তিন দিন ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন থাকার পর সোমবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তিনি জীবন হারান।

নিহতের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, পারভেজ খান সদর উপজেলার বারাইভিকড়া এলাকার আবুল হোসেনের ছেলে ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ওই স্কুলে বাস চালাতেন এবং নিজের সততা ও দায়িত্বপরায়ণতার কারণে এলাকার মানুষজনের কাছে পরিচিত ছিলেন। পারভেজ খানের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

দুর্ঘটনার বিবরণ

ঘটনাটি ঘটেছিল শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) রাতের দিকে। শিবালয় উপজেলার ফলসাটিয়া এলাকায় থেমে থাকা হলি চাইল্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাসটিতে দুর্বৃত্তরা আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন লাগার সময় বাসের ভিতরে থাকা পারভেজ খান দগ্ধ হন। সহকর্মীরা এবং স্থানীয়রা দ্রুত তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান এবং পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা বলেছিলেন, দগ্ধতার মাত্রা অত্যন্ত গুরুতর ছিল এবং পারভেজ খানের শ্বাসনালি ও শরীরের বড় অংশে তাপপ্রভাব বিস্তৃত। তিন দিন ধরে চিকিৎসাধীন থাকলেও অবশেষে সোমবার তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

পরিবারের প্রতিক্রিয়া

পারভেজ খানের পরিবার গভীর শোকের মধ্যে রয়েছে। নিহতের স্ত্রী ও দুই সন্তান বর্তমানে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। পারভেজ খানের ভাই বলেন, “আমরা জানতাম তিনি অত্যন্ত যত্নশীল মানুষ। সে প্রতিদিনই শিক্ষার্থীদের নিরাপদে স্কুলে পৌঁছানোর জন্য দায়িত্ব পালন করতেন। এভাবে হারানো আমাদের জন্য একটি বড় ধাক্কা।”

স্থানীয় জনগণও এই ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। অনেকেই বলছেন, স্কুল পরিবহন ব্যবস্থার নিরাপত্তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও সতর্ক হতে হবে।

নিরাপত্তা ও অপরাধ তদন্ত

স্থানীয় পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বাসে আগুন ধরানোর ঘটনা একটি পূর্বপরিকল্পিত অপরাধ। পুলিশ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছে। শিবালয় থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জানান, “আমরা ইতিমধ্যেই কিছু প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করেছি এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। আমরা দ্রুত এই মামলার মূল হোতাদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছি।”

স্কুল পরিবহন নিরাপত্তার প্রশ্ন

এই মর্মান্তিক ঘটনার পর স্কুল পরিবহন নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত বাসগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা, ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার, এবং বিশেষ করে চালকদের জন্য নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ থাকা অত্যন্ত জরুরি।

শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বলছেন, স্কুলবাসে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রাথমিক কর্তব্য। পারভেজ খানের মতো দায়িত্বশীল চালক থাকলেও নিরাপত্তার অভাব এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে।

প্রতিবেশী ও এলাকাবাসীর প্রতিক্রিয়া

পরিবেশের মানুষজনও এই ঘটনায় হতবাক। একজন স্থানীয় বলেন, “এটা শুধু পারভেজ খানের জন্য নয়, আমাদের সব শিশুর জন্য দুঃখের। আমরা চাই, প্রশাসন যেন দ্রুত এই ধরনের অপরাধ দমন করে।”

অন্য একজন বলেন, “শহরের স্কুল বাসে আগুন লাগানো অল্প সময়ের জন্য ঘটেনি। এটি একটি পরিকল্পিত অপরাধ। এর সাথে জড়িতদের দ্রুত শাস্তি হওয়া উচিত।”

দেশের প্রেক্ষাপটে স্কুল পরিবহন নিরাপত্তা

বাংলাদেশে স্কুল পরিবহন নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বড় শহর থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত শিশু শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন স্কুল-হোম যাতায়াত করে। কিন্তু নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রায়ই অপ্রতুল থাকে। বিভিন্ন শহরে স্কুলবাস সংক্রান্ত দুর্ঘটনার খবর মাঝে মাঝে প্রকাশ পায়, যার ফলে অভিভাবকরা আতঙ্কিত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি স্কুলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা, চালক ও হেল্পারদের নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং জরুরি অবস্থায় দ্রুত সাড়া দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম রাখা অপরিহার্য।

সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা

সোশ্যাল মিডিয়ায় পারভেজ খানের মৃত্যু নিয়ে অনেকেই শোক প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ স্থানীয় প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করার আহ্বান জানিয়েছেন যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ করা যায়।

একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “যে চালক তিন দিনের মধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, তার মৃত্যুর জন্য আমাদের স্কুল পরিবহন নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা প্রস্তুত ছিল তা ভাবতে হবে।”

পুলিশ ও প্রশাসনের পদক্ষেপ

স্থানীয় পুলিশ ইতিমধ্যেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। ওসি জানান, “আমরা স্থানীয় নিরাপত্তা গ্যাংদের সঙ্গে সমন্বয় করছি এবং সন্দেহভাজনকে দ্রুত ধরার চেষ্টা চলছে। এটি একটি পরিকল্পিত ঘটনা, আমরা দ্রুত তদন্ত শেষ করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করব।”

অপরদিকে, জেলা প্রশাসকও ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, “পারভেজ খানের মৃত্যু একটি বড় ক্ষতি। আমরা পরিবারকে সকল সহায়তা প্রদান করব। এ ধরনের ঘটনা আর যেন না ঘটে তার জন্য স্কুল পরিবহন নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হবে।”

পারভেজ খানের মর্মান্তিক মৃত্যু শুধু তার পরিবার নয়, সমগ্র মানিকগঞ্জের জন্য একটি গভীর ক্ষতি। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে স্কুল পরিবহন নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন অত্যন্ত জরুরি। স্থানীয় প্রশাসন, স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং অভিভাবকদের একসাথে কাজ না করলে এ ধরনের দুর্ঘটনা থেকে শিশুরা, চালকরা এবং স্থানীয় জনগণ নিরাপদ থাকতে পারবে না।

এ ঘটনা আমাদের সতর্ক করে দেয় যে, ছোট শহর বা গ্রামাঞ্চলেও পরিকল্পিত অপরাধ ঘটতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পুলিশ, এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষকে একত্রিত হয়ে শিশু শিক্ষার্থীদের এবং স্কুল কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

সংক্ষেপে:

  • মানিকগঞ্জ শিবালয়ে হলি চাইল্ড স্কুল বাসে আগুন লাগায় চালক পারভেজ খান মারা গেছেন।
  • তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে তিন দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন।
  • পারভেজ খানের মৃত্যু স্থানীয়দের মধ্যে শোক ও নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি করেছে।
  • পুলিশ তদন্ত করছে, স্কুল পরিবহন নিরাপত্তা পুনর্বিবেচনার আহ্বান উঠেছে।

MAH – 13841 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button