জাতীয়

হাসিনাকে ফাঁসি দিলে কাউকে বাঁচতে দেয়া হবে না; চিফ প্রসিকিউটরকে ভারতীয় নম্বর থেকে হুমকি

Advertisement

জুলাই–আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ফ্যাসিস্ট সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের আরও দুই প্রভাবশালী নেতাসহ মোট তিনজনের বিরুদ্ধে বহুল আলোচিত রায় আজ সোমবার (১৭ নভেম্বর) ঘোষিত হওয়ার কথা। রায়কে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন, আদালতপাড়া এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যেই বিচারকার্য পরিচালনাকারী প্রসিকিউশন টিমের সদস্যদের কাছে ভারতীয় কান্ট্রি কোড (+৯১) ব্যবহার করে একের পর এক হুমকি ফোন আসতে শুরু করেছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়—এই হুমকির লক্ষ্য হিসেবে সামনে আনা হয়েছে চিফ প্রসিকিউটরসহ পুরো প্রসিকিউশন টিমকে।

রবিবার দিবাগত রাত থেকেই এই হুমকি অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন দলের সদস্যরা। শুধু অশ্রাব্য গালিগালাজই নয়, রীতিমতো হত্যার হুমকি দিয়ে বলা হচ্ছে—“হাসিনাকে ফাঁসি দিলে কাউকে বাঁচতে দেওয়া হবে না।”

আইন–আদালতসংশ্লিষ্ট মহলে এই ঘটনায় নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে ইতিমধ্যে তীব্র আলোচনা শুরু হয়েছে।

হুমকি ফোনের বিস্তারিত: ‘একই ভাষা, একই ভয় দেখানো’

প্রসিকিউশন টিমের সদস্যরা জানান, গতকাল রাত থেকে তাঁরা প্রত্যেকে এক বা একাধিক অজ্ঞাত নম্বর থেকে ফোন পেয়েছেন। অধিকাংশ নম্বরেই ভারতীয় কান্ট্রি কোড ব্যবহার করা হয়েছে। ফোনকলগুলোতে টানা গালিগালাজ এবং ভয় দেখানোর পাশাপাশি এক ধরনের সমন্বিত হামলার আশঙ্কার কথাও উঠে এসেছে।

প্রসিকিউটর তারেক আবদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন—

“রবিবার সন্ধ্যার পর থেকেই অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসতে থাকে। প্রথমে ভেবেছি হয়তো কেউ ভুল করেছে। কিন্তু পরে দেখি একই ধরনের ভাষায় একের পর এক হুমকি। আজ সকালেও প্রায় পাঁচটি ফোন পেয়েছি। প্রায় সবগুলোর কান্ট্রি কোড ভারতীয়। বলা হচ্ছে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায় গেলে আমাদের কাউকে বাঁচতে দেবে না।”

তিনি আরও জানান যে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কথা বলার ধরন দেখে মনে হয়েছে একটি প্রশিক্ষিত দল বা সমন্বিত কোনো নেটওয়ার্ক এই হুমকির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। তাদের বক্তব্যের ধরন প্রায় একই—উদ্দেশ্য প্রসিকিউশন টিমকে ভয় দেখানো।

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন—

“এত ফোন এসেছে যে শেষ পর্যন্ত মোবাইল বন্ধ করে দিতে হয়েছে। একই শব্দ, একই দাবি, একই হুমকি। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে—এটা পরিকল্পিত। বলা হচ্ছে, নেত্রী (শেখ হাসিনা) শাস্তি পেলে আমাদের জীবন শেষ করে দেবে।”

তবে তিনি স্পষ্ট করে জানান যে এই ধরনের ভয়ভীতি আইনের পথে এগিয়ে যেতে কোনোভাবেই বাঁধা সৃষ্টি করতে পারবে না।

হুমকিদাতারা কারা? তদন্তে নামছে পুলিশ ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ একটি সূত্র জানিয়েছে যে এই ধরনের হুমকি ফোন সাধারণত প্রি-অ্যাক্টিভেশন ভিওআইপি সিম, হোয়াটসঅ্যাপ কল বা ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা থেকে করা হয়। ফলে প্রকৃত উৎস শনাক্ত করতে প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণের প্রয়োজন হবে।

এক কর্মকর্তা বলেন—

“কান্ট্রি কোড ভারতীয় হলেও কল বাস্তবেই ভারত থেকে করা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত নয়। অনেক অপরাধী VPN বা স্পুফড কল ব্যবহার করে নম্বর লুকায়। তবে হুমকির ভাষা ও সময় নির্বাচন বিবেচনায় নিলে এটি অত্যন্ত উদ্দেশ্যমূলক।”

ডিজিটাল সিকিউরিটি ইউনিট, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন এবং পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইউনিট ইতোমধ্যে কল-লগ বিশ্লেষণ শুরু করেছে।

নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে প্রসিকিউশন টিমের সদস্যদের জন্য

হুমকির ঘটনাটি গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পর আইন মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উভয়েই প্রসিকিউশন টিমের সদস্যদের নিরাপত্তা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আদালতপাড়া, চিফ প্রসিকিউটরের বাসা এবং দলের কয়েকজন সদস্যের কর্মস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

একজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা জানান—

“এমন সংবেদনশীল রায়ের আগে হুমকি পাওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রয়োজন হলে প্রত্যেক সদস্যের ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় এসকর্ট টিমও যুক্ত করা হবে।”

প্রসঙ্গ: জুলাই–আগস্ট আন্দোলনের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলা

২০২৫ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনের সময় ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। বহু এলাকায় অগ্নিসংযোগ, পরিকল্পিত হত্যা, নির্যাতন, ধরপাকড়, বেসামরিক লোকদের ওপর আক্রমণসহ একাধিক মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে তদন্তে উঠে আসে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আওতাধীন বিশেষ বেঞ্চ এ ঘটনাগুলোর তদন্ত করে।

তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়—

  • মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু ঘটনা ছিল “রাষ্ট্রীয় মদদে সংঘটিত”
  • তৎকালীন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের “পরিকল্পনায় সক্রিয় ভূমিকা” ছিল
  • নির্দিষ্ট হত্যাকাণ্ডগুলোকে “কোঅর্ডিনেটেড ক্রাইম” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়
  • সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পদের ওপর পরিকল্পিত হামলার প্রমাণ পাওয়া যায়

এসব অভিযোগের ভিত্তিতেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর সরকারের দুই শীর্ষ নেতাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ গঠন হয়।

আজ যার রায় ঘোষণা হতে যাচ্ছে—সেটি তাই অত্যন্ত ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

বিচারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা? আইনজ্ঞদের মন্তব্য

আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, রায়ের আগমুহূর্তে এই ধরনের হত্যার হুমকি কেবল ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে নয়—এটি বিচারিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার একটি কৌশলও হতে পারে।

সুপ্রিম কোর্টের একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর মন্তব্য—

“গুরুত্বপূর্ণ রায়ের আগে প্রসিকিউশনকে হুমকি দেওয়া মানে বিচার প্রক্রিয়াকেই ভয় দেখানো। এটি যেকোনো দেশের আইনের শাসনের প্রতি সরাসরি আঘাত।”

আরেকজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ বলেন—

“এটা খুবই পরিকল্পিত মনে হচ্ছে। যে ভাষায় হুমকি দেওয়া হয়েছে তা স্পষ্টতই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূরণে ব্যবহৃত। আদালতের স্বাধীনতা রক্ষায় এই হুমকিদাতাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”

চিফ প্রসিকিউটরের প্রতিক্রিয়া: ‘ভীরুদের ভাষা এমনই’

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম এই ঘটনার ব্যাপারে দারুণ দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বলেন—

“ভীরু, কাপুরুষ এবং যারা গণহত্যা করে তাদের ভাষা এমনই হয়। ভয় দেখিয়ে তারা বিচার থামাতে চায়। এসব আমলে নেয়ার কিছু নেই। আইন তার নিজের পথে চলবে।”

তিনি আরও বলেন—

“যারা নিয়মতান্ত্রিক বিচারপ্রক্রিয়াকে ভয় পায়, তারাই এমন হুমকি দিয়ে থাকে। রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা নিরাপত্তা চাই না—আমাদের শক্তি জনগণের বিশ্বাস ও আইনের শাসন।”

জনমনে উদ্বেগ—রায়কে ঘিরে বাড়তি উত্তেজনা

রায়ের আগে এমন হুমকি সামনে আসায় সাধারণ মানুষের মধ্যেও উদ্বেগ বাড়ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন—

  • ইতোমধ্যেই আদালতপাড়া ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কঠোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে
  • রায় ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রস্তুত
  • সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হচ্ছে
  • গুজব প্রতিরোধে সাইবার টহল বাড়ানো হয়েছে

বিভিন্ন মহল মনে করছে—এই রায়ে দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বড় পরিবর্তন আসতে পারে, তাই অনেকে আগেভাগে বিচার ব্যাহত করার চেষ্টা করছে।

হুমকি সত্ত্বেও রায় ঘিরে দেশজুড়ে নজর

আজকের রায়টি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত বিচারগুলোর একটি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ—আর এই রায়ের ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।

হুমকি সত্ত্বেও প্রসিকিউশন টিমের দৃঢ় অবস্থান, নিরাপত্তা জোরদারকারী প্রশাসন এবং বিচারকদের স্বাধীনতার প্রতি অটল আস্থা—সব মিলিয়ে দেশের মানুষ আজ অপেক্ষা করছে একটি স্বচ্ছ, ন্যায়সংগত ও ঐতিহাসিক রায়ের।

MAH – 13838 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button