মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় নিরাপত্তা জোরদারে সেনা মোতায়েনের জন্য সেনা সদরে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। চলমান পরিস্থিতিকে অত্যন্ত সংবেদনশীল বিবেচনা করে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রতিরোধে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে রাজধানীর সুপ্রিম কোর্ট ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সেনা মোতায়েনের জন্য চিঠি পাঠিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও মামলাটির গুরুত্ব বিবেচনায় নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।
ঘটনা ও চিঠি পাঠানোর বিস্তারিত
সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে শনিবার সেনা সদর দপ্তরে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, মামলাটির সংবেদনশীলতা ও চলমান পরিস্থিতির কারণে ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রিম কোর্ট চত্বরের নিরাপত্তা জোরদার করা জরুরি। বিশেষত রায় ঘোষণার দিনকে কেন্দ্র করে এলাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত বা সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে পর্যাপ্তসংখ্যক সেনাসদস্য মোতায়েনের অনুরোধ জানানো হয়।
সুপ্রিম কোর্টের জনসংযোগ দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, রায়ের দিন সংশ্লিষ্ট এলাকায় মানুষের চাপ, রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং সম্ভাব্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রয়োজন। চিঠি পাওয়ার পর সেনা সদর দপ্তর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে কাজ শুরু করেছে বলেও জানা যায়।
মামলার প্রেক্ষাপট ও পূর্বপটভূমি
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ তিনজনকে আসামি করে এ মামলা দায়ের করা হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে এই মামলার অগ্রগতি চলে এবং ধাপে ধাপে সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করা হয় সোমবার, ১৭ নভেম্বর।
এর আগে গত বৃহস্পতিবারও রায় ঘোষণার তারিখকে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সেনা মোতায়েনের জন্য চিঠি দিয়েছিল। সেই অনুযায়ী সেনা সদস্যরা সুপ্রিম কোর্ট এলাকা ও ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন পয়েন্টে দায়িত্ব পালন করে। এবার রায় ঘোষণার মাত্র একদিন আগে আবার নতুন করে নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশনা দেওয়া হলো।
এই মামলাটি দেশের রাজনীতি, সামাজিক আলাপ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। রায়ের প্রতি জনসাধারণের আগ্রহ যেমন বেশি, তেমনি ভিন্নমতের প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
নিরাপত্তা ঝুঁকি ও কর্তৃপক্ষের সতর্কবার্তা
সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং সামাজিক মাধ্যমে বাড়তে থাকা উত্তপ্ত আলোচনা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করতে পারে। সম্ভাব্য নাশকতা, ভিড়, বিক্ষোভ কিংবা আদালত এলাকায় উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরির ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, রায় ঘোষণার দিন আদালত চত্বরের ভেতর-বাইরে অতিরিক্ত পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সদস্য মোতায়েন থাকবে। সেনা সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথ, আদালত ভবনের চারপাশ ও সংবেদনশীল পয়েন্টগুলোর নিরাপত্তা তদারকি করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
আদালত ও ট্রাইব্যুনাল এলাকায় প্রস্তুতি
রায়ের দিন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে ট্রাইব্যুনাল ভবনের ভেতর ও বাইরে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ কঠোর করা হয়েছে। আদালতের বিভিন্ন প্রবেশমুখে চেকপোস্ট স্থাপন, পথচারীদের তল্লাশি, মিডিয়া প্রবেশ নিয়ন্ত্রণসহ বেশ কিছু অতিরিক্ত নিয়ম আরোপ করা হচ্ছে।
আদালত প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা জানান, রায় ঘোষণার দিন সাধারণ মানুষ, কর্মচারী ও আইনজীবীদের জন্যও বিশেষ প্রবেশপদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। সাংবাদিকদেরও পরিচয় যাচাইয়ের পর নির্দিষ্ট এলাকায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে।
এ ছাড়া আশপাশের সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে রাখতে ট্রাফিক বিভাগ বিশেষ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। রায় ঘোষণার ঘণ্টাখানেক আগে থেকেই কিছু রাস্তা আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রাখা হতে পারে।
সম্ভাব্য প্রভাব ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
মামলাটির রায়ের ওপর দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে, তা নিয়ে নানা জল্পনা রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো ইতিমধ্যে রায় ঘোষণার আগেই নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। কেউ কেউ দাবি করছেন, রায় যাই হোক না কেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেন স্বাভাবিক থাকে, সে বিষয়ে সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সেনা মোতায়েন একটি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা, যার লক্ষ্য সম্ভাব্য সংঘাতকে আগাম প্রতিরোধ করা। আদালত চত্বরের নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া শুধু আইনশৃঙ্খলা নয়, বিচার প্রক্রিয়ার সুষ্ঠুতা রক্ষার সঙ্গেও সম্পর্কিত।
বিশেষজ্ঞ মতামত ও বিশ্লেষণ
বিশেষজ্ঞদের মতে, উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে গঠিত মামলা হলে সাধারণত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। তবে এবার পরিস্থিতি আরও সংবেদনশীল হওয়ায় সেনা মোতায়েনের চিঠি আদালতের গভীর সতর্কতার ইঙ্গিত বহন করছে।
একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জানান, গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলো এখনো অস্থির। এমন সময় জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় ঘোষণা হলে জনমনে উত্তেজনা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। তাই নিরাপত্তা নিশ্চিত করার এই প্রস্তুতিকে জরুরি ও সময়োপযোগী মনে করছেন বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ।
শেখ হাসিনাসহ তিনজনকে নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন অধ্যায় তৈরি করতে যাচ্ছে। রায় ঘোষণার আগে সুপ্রিম কোর্ট ও ট্রাইব্যুনাল এলাকা সেনা মোতায়েনের অনুরোধ নিরাপত্তা ঝুঁকির গুরুত্বই তুলে ধরে। এখন দেখার বিষয়, রায়ের পর দেশের সামগ্রিক পরিবেশ কোন দিকে এগোয়। সংশ্লিষ্ট সকলের দায়িত্বশীল আচরণই পারে পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল রাখতে।
এম আর এম – ২২৬১,Signalbd.com



