প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন স্পষ্ট করে বলেছেন, দেশের প্রচলিত আইন, বিধি-বিধান ও বিবেকের আলোকে নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব পালন করবে। কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে কাজ করার প্রশ্নই ওঠে না। আগারগাঁওয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে তিনি এ বার্তা দেন।
সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন কারও হয়ে কাজ করবে না; কমিশনের একমাত্র পথনির্দেশক হবে দেশের বিদ্যমান আইন ও বিধান। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে তিনি আচরণবিধি পালন, নির্বাচনী পরিবেশ রক্ষা এবং প্রযুক্তিনির্ভর নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবার সহযোগিতা কামনা করেন।
ঘটনা ও সিইসি’র বক্তব্যের বিস্তারিত
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শুরু হওয়া ধারাবাহিক সংলাপের প্রথম দিন সিইসি তার বক্তব্যে কমিশনের অবস্থান স্পষ্ট করেন। তিনি বলেন, অনেকেই মনে করেন ইসি যদি তাদের পক্ষে কাজ করে, তাহলে সেটাই ন্যায়পরায়ণতা। কিন্তু কমিশনের দায়িত্ব হলো সংবিধান, আইন ও নীতিমালার ভিত্তিতে নির্বাচন পরিচালনা করা।
সিইসি জানান, একটি সুন্দর, গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করতে নির্বাচনী আচরণবিধি প্রণয়ন করা হয়েছে, যা রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা ছাড়া বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এই আচরণবিধি যাতে মাঠপর্যায়ে কার্যকর হয়, সে বিষয়ে তিনি দলগুলোর সমর্থন চান।
সংলাপ আয়োজনের পটভূমি
নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই রাজনৈতিক দল, নির্বাচনী অংশীজন এবং বিভিন্ন সংগঠনের মতামত গ্রহণের চেষ্টা করছে। এর আগেও ইলেকটোরাল রিফর্মস কমিশন ও ঐকমত্য কমিশন নানা সুপারিশ জমা দিয়েছে, যা ইসির কাজকে সহজ করেছে বলে উল্লেখ করেন সিইসি।
সংলাপ আয়োজন কিছুটা দেরিতে শুরু হওয়ায় তিনি দুঃখপ্রকাশ করেন, তবে একই সঙ্গে জানান যে ইসির অভ্যন্তরীণ ব্যস্ততা এবং রাজনৈতিক দলের সময়সূচি মিলিয়ে চূড়ান্ত পরিকল্পনা করতে বাড়তি সময় প্রয়োজন হয়েছিল।
রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা কেন জরুরি
একটি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা অনেকাংশেই নির্ভর করে রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ, প্রচারণার পরিবেশ, এবং আইন মানার ওপর। সিইসি বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘন কমাতে প্রার্থীদের আন্তরিকতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি উল্লেখ করেন, যদি রাজনৈতিক দলগুলো সত্যিকারের সহযোগিতা করে, তাহলে কঠোর আইন প্রয়োগের প্রয়োজন হবে না। এতে নির্বাচনের পরিবেশ আরও স্বচ্ছ, শান্তিপূর্ণ এবং প্রতিযোগিতামূলক হবে।
এ ছাড়া, মনোনয়নপত্র যাচাই, প্রচারণা, অস্থায়ী আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা, ভোটকেন্দ্র ব্যবস্থাপনা—সব ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলের দায়িত্বশীল আচরণ সমগ্র প্রক্রিয়াকে মসৃণ করে।
নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নতুন চ্যালেঞ্জ: অপতথ্য ও এআই ব্যবহার
বর্তমান কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে সিইসি উল্লেখ করেন সোশ্যাল মিডিয়া ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ভুল তথ্য ও অপতথ্য ছড়ানো।
তার ভাষায়, আগের কোনো কমিশনকে এ ধরনের প্রযুক্তি-ভিত্তিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়নি। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আপলোড হওয়া ভুয়া তথ্য ভোটারদের সিদ্ধান্তে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে। এমনকি দেশের সীমানার বাইরে থেকেও কিছু সংগঠিত বিভ্রান্তি ছড়ানোর প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, এসব মোকাবিলায় রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সত্য ও যাচাই করা তথ্য প্রচারই ভোটারদের আস্থা ধরে রাখতে পারে।
আচরণবিধির গুরুত্ব ও কমিশনের প্রস্তুতি
ইসির ওয়েবসাইটে দীর্ঘদিন ধরে আচরণবিধির খসড়া উন্মুক্ত রাখা হয়েছিল। এ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্টেকহোল্ডাররা তাদের লিখিত মতামত পাঠিয়েছে। সেসব পর্যালোচনার ভিত্তিতে চূড়ান্ত আচরণবিধি প্রস্তুত করা হয়েছে।
সিইসি বলেন, আচরণবিধি মানা শুধু কমিশনের দায়িত্ব নয়; রাজনীতিবিদ, প্রার্থী, কর্মী, এমনকি ভোটারদেরও সচেতন হতে হবে। নির্বাচনী পরিবেশ যত শান্তিপূর্ণ হবে, ভোটারদের অংশগ্রহণ তত বাড়বে, আর গ্রহণযোগ্যতাও ততই নিশ্চিত হবে।
বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি
নির্বাচন বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, সিইসির এই ঘোষণা বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। তারা মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ নির্বাচনকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে সহায়ক হতে পারে।
এছাড়া তারা উল্লেখ করেন, ডিজিটাল অপতথ্যের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া জরুরি। কারণ, বিভ্রান্তিকর প্রচারণা নির্বাচন ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ন করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নির্বাচন কমিশন যদি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে, তাহলে এসব চ্যালেঞ্জ অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।
সারসংক্ষেপ ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
সিইসির বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে, নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষতা ও আইনের শাসনের প্রশ্নে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। কমিশনের প্রত্যাশা, রাজনৈতিক দলগুলো সহযোগিতা করলে নির্বাচনী পরিবেশ আরও ইতিবাচক হবে।
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সংলাপ, আচরণবিধি বাস্তবায়ন, অপতথ্য মোকাবিলা এবং প্রযুক্তিনির্ভর প্রস্তুতি—সব মিলিয়ে ইসির সামনে ব্যস্ত সময়। এখন সবার চোখ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়ার দিকে। ভবিষ্যতের রাজনৈতিক আচরণই ঠিক করবে এই অঙ্গীকার কতটা বাস্তবে রূপ নেবে।
এম আর এম – ২২৫৫,Signalbd.com



