আঞ্চলিক

বরিশালে বাস বন্ধ: শিক্ষার্থী–শ্রমিক সংঘর্ষ

Advertisement

বরিশালের পরিবহন খাতে আবারও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শনিবার রাতে বরিশাল বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের সংঘর্ষের জেরে রোববার সকাল থেকে জেলার ভেতরের সব রুটে এবং দূরপাল্লার সব বাস চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়ন জানিয়েছে, ভাঙচুর হওয়া গাড়িগুলোর ক্ষতিপূরণ না দেওয়া পর্যন্ত এই ধর্মঘট চলবে। এর ফলে হাজারো যাত্রীকে পড়তে হচ্ছে চরম দুর্ভোগে।

বরিশাল নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালসহ জেলার প্রধান প্রধান প্রবেশমুখে সকাল থেকেই নেই কোনো দূরপাল্লা ও আন্তঃজেলা বাস। যাত্রীদের কেউ দাঁড়িয়ে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কেউ আবার অতিরিক্ত ভাড়ায় মাহিন্দ্রা বা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ভরসা করে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন।

কীভাবে শুরু হলো সংঘর্ষ?

শনিবার সন্ধ্যার পর বরিশাল কেন্দ্রীয় নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালে ‘হাফ ভাড়া’ নেওয়া–নেওয়া নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিএম কলেজের বেশ কিছু শিক্ষার্থী নথুল্লাবাদ থেকে শহরের বিভিন্ন স্থানে হাফ ভাড়া দেওয়ার দাবি জানায়। কিন্তু শ্রমিকরা জানায়, তারা দূরপাল্লার বাসে হাফ ভাড়া প্রযোজ্য করেন না। এই নিয়ে তর্ক–বিতর্ক দ্রুতই ধাক্কাধাক্কিতে রূপ নেয়।

এর পরপরই দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয় ধাওয়া–পাল্টাধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং মারধরের ঘটনা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অল্প সময়ের মধ্যেই পুরো টার্মিনাল এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীদের একটি বড় দল আশপাশের রাস্তায় জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েকজন জানান, কিছু শ্রমিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উত্তেজনাপূর্ণ ভাষায় কথা বলায় পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

২০ থেকে ৩০টি বাস ভাঙচুর, কয়েকটিতে অগ্নিসংযোগ

সংঘর্ষের সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা অন্তত ২০–৩০টি বাসে ভাঙচুর চালায়। কিছু বাসে অগ্নিসংযোগও করা হয় বলে নিশ্চিত করেন টার্মিনালে কর্তব্যরত শ্রমিকরা। ভাঙচুরের ফলে নথুল্লাবাদ থেকে বরিশাল–ঢাকা মহাসড়কের একটি অংশ কয়েক ঘণ্টা অচল হয়ে পড়ে।

সেসময় যাত্রীদের অনেকে জানান, হঠাৎ পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় অনেকেই টার্মিনাল ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান। রাত পর্যন্ত এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করলেও পুলিশ, র‍্যাব এবং পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা যৌথভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

পরিবহন মালিক–শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দাবি: প্রায় ২ কোটি টাকার হিসাব

ধর্মঘটপন্থী মালিক–শ্রমিক নেতাদের দাবি, সারারাত পুলিশি তৎপরতা সত্ত্বেও অন্তত ২ কোটি টাকার মতো আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ভাঙচুর হওয়া বিভিন্ন দূরপাল্লার বাস, অভ্যন্তরীণ রুটের মিনিবাস, টিকিট কাউন্টার, গ্যারেজ এবং শ্রমিকদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বরিশাল নথুল্লাবাদ শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি শাহাদাত হোসেন লিটন বলেন—

“আমাদের দায়িত্বে থাকা গাড়িগুলো ভাঙচুর করা হয়েছে। এগুলোর প্রতিটির ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এছাড়া প্রায় ৫০ জন শ্রমিক আহত হয়েছে, যাদের চিকিৎসা আমরা চালাচ্ছি। কিন্তু ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনা আর না ঘটে—এ বিষয়ে প্রশাসনের নিশ্চয়তাও চাই। এই শর্ত পূরণ না হওয়া পর্যন্ত গাড়ি চলবে না।”

তিনি আরো বলেন, শিক্ষার্থীরা বারবার হাফ ভাড়ার অজুহাতে শ্রমিকদের সঙ্গে অসদাচরণ করেন। বিষয়টি সমাধানে সরকার ও প্রশাসনকে নিয়ম মানার মতো স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

যাত্রীদের দুর্ভোগ: দ্বিগুণ ভাড়া, অনিশ্চয়তার ভয়

ধর্মঘট শুরু হওয়ার পর থেকেই বরিশাল শহর ও জেলার বিভিন্ন রুটে সাধারণ মানুষ পড়েছে মারাত্মক ভোগান্তিতে। বিশেষ করে অফিসগামী মানুষ, পরীক্ষার্থীরা এবং হাসপাতালে যেতে ইচ্ছুক রোগী ও তাদের স্বজনেরা পড়েছে বড় সমস্যায়।

যাত্রীরা যা বলছেন:

মেহেদী হাসান (চাকুরিজীবী), আগরপুর থেকে নথুল্লাবাদ:

“কাজে যেতে হবে। কিন্তু কোনো বাস নেই। মাহিন্দ্রা ভাড়া আগের চেয়ে দ্বিগুণ নিচ্ছে। বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত টাকা দিচ্ছি।”

তাসনিম (বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী), কীর্তনখোলা থেকে বরিশাল সদর:

“গতকাল যারা ভাঙচুর করেছে, তারা নিশ্চয় দোষী। কিন্তু তার শাস্তি তো আমাদের ভোগতে হচ্ছে! কলেজে পরীক্ষা আছে, বাস না পাওয়ায় খুব বিপদে পড়েছি।”

মহাসড়কে যান চলাচল ব্যাহত

বরিশাল–ঢাকা মহাসড়ক, বরিশাল–পটুয়াখালী রুট এবং বরিশাল–ভোলা নৌ–সংযোগ এলাকায় যানবাহনের চাপ কমে গেছে। যেসব ব্যক্তিগত যানবাহন চলছে, সেগুলোতে ভাড়া বাড়তি।

পরিবহন বন্ধ থাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারেও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কিছু পাইকারি আড়তে পরিবহন ব্যাহত হওয়ায় পণ্য সরবরাহ কমে গেছে বলে ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন।

হাফ ভাড়া নিয়ে স্থায়ী সমাধানের দাবি

দেশের বিভিন্ন জেলায় গত কয়েক বছর ধরেই শিক্ষার্থীরা গণপরিবহনে হাফ ভাড়া নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে আসছে। যদিও কিছু রুটে এই দাবি আংশিকভাবে মেনে নেওয়া হয়েছে, বেশিরভাগ রুটেই তা বাস্তবায়িত হয়নি।

বরিশালের শিক্ষার্থীরা বলছে, রাজধানীতে হাফ ভাড়া বাস্তবায়িত হলেও দেশের অন্যান্য জেলায় তা মানা হয় না। ফলে শ্রমিক–শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই ধরনের উত্তেজনা প্রায়ই দেখা যায়।

শিক্ষার্থী নেতারা জানান—

“আমরা শুধু সরকারের ঘোষিত নীতিমালা বাস্তবায়ন চাই। শ্রমিকদের সঙ্গে সংঘর্ষ আমাদের লক্ষ্য নয়। কিন্তু দাবি না মানলে আন্দোলন করব।”

প্রশাসনের ভূমিকা: সমঝোতার চেষ্টা চলছে

বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি শান্ত করে এবং পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা মিলে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। তিনি জানান—

“শিক্ষার্থী–শ্রমিক উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা চলছে। ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হতে পারে।”

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, আজ বিকেলে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসছে জেলা প্রশাসন। সেখানে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি ও কলেজ প্রশাসনকেও ডাকা হতে পারে।

টানা ধর্মঘট হলে অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়বে

বরিশালের অর্থনীতি মূলত পরিবহনের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। বিশেষ করে নদী–বেষ্টিত এই অঞ্চলে দূরপাল্লার রুটে সড়কপথ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বরিশালে বাস বন্ধ: শিক্ষার্থী–শ্রমিক সংঘর্ষ, দুর্ভোগে যাত্রীরাপরিবহন বন্ধ থাকলে কৃষিপণ্য, মাছ, ফলমূল—সবকিছুর সরবরাহ ব্যাহত হয়।

স্থলবন্দর, নৌঘাটসহ গুরুত্বপূর্ণ পণ্য পরিবহন ব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে সতর্ক করেছেন ব্যবসায়ীরা।

বরিশাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির এক প্রতিনিধি বলেন—

“দুই–তিন দিনের মধ্যে সমস্যা সমাধান না হলে বাজারে প্রভাব পড়বে। ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন, সাধারণ মানুষও কষ্টে পড়বে।”

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার ঝড়

ঘটনার ভিডিও ও ছবি ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। শিক্ষার্থীরা একটি অংশ শ্রমিকদের দোষারোপ করছে, আবার শ্রমিকদের একটি অংশ বলছে শিক্ষার্থীরা অহেতুক উত্তেজনা ছড়িয়েছে।

এই বিভাজন আরও বড় হয়ে যেতে পারে বলে অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।

সম্ভাব্য সমাধান কী?

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন—

  • শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসনকে স্পষ্ট নির্দেশনা দিতে হবে
  • পরিবহন মালিক–শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে
  • শিক্ষার্থীদেরও আচরণবিধি নিশ্চিত করতে কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে
  • টার্মিনালে স্থায়ী পুলিশ বুথ ও সিসিটিভি মনিটরিং বাড়াতে হবে

এই ব্যবস্থা নেওয়া গেলে ভবিষ্যতে সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হতে পারে।

MAH – 13829 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button