পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুসলমানরা একই উম্মাহর অংশ এবং এই ঐক্য কখনোই ভাঙার নয় বলে মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের প্রভাবশালী ইসলামী নেতা ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম পাকিস্তানের সভাপতি মাওলানা ফজলুর রহমান। দুই দেশের মাঝে ঐতিহাসিক ভুল–বোঝাবুঝি দূরে রেখে নতুন করে সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন তৈরি করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত এক বৃহৎ খতমে নবুয়ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এক পা এগোলে, পাকিস্তান দুই পা এগিয়ে আসবে। কারণ আমাদের বন্ধন শুধু রাজনৈতিক নয়—এটি ঈমান, বিশ্বাস ও ইসলামী ঐতিহ্যের গভীর সম্পর্ক।”
রোববার (১৬ নভেম্বর) প্রকাশিত পাকিস্তানি প্রভাবশালী দৈনিক দ্য ডন–এর প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। সম্মেলনে অংশ নিতে পাকিস্তান থেকে উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দলও বাংলাদেশে আসে।
ধর্মীয় নেতৃত্ব থেকে রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক—নতুন বার্তা দুই দেশের জন্য
মাওলানা ফজলুর রহমান বলেন, ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলমানদের মাঝে কোনো বিভাজন নেই। তারা যেখানেই থাকুক, তা বাংলাদেশ–পাকিস্তান–ভারত–মধ্যপ্রাচ্য বা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই হোক, তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট।
তিনি বলেন,
“আমরা একই উম্মাহর সন্তান। কেউ সীমানা টেনে আমাদের আলাদা করতে পারবে না। ইতিহাসে যত মতভেদ থাকুক, আজকের বাস্তবতায় মুসলমানদের ঐক্যই আমাদের শক্তি।”
তার মতে, বাংলাদেশে মানুষের ধর্মীয় চেতনা অত্যন্ত দৃঢ় এবং এখানকার জনগণ ইসলামী মূল্যবোধ ধরে রেখেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি ইতিবাচক উদাহরণ।
খতমে নবুয়ত—দুই দেশের অভিন্ন বিশ্বাস
সম্মেলনে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, খতমে নবুয়ত বা নবুওয়তের সমাপ্তি এমন একটি বিশ্বাস যা পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুসলমানদের অভিন্ন আকীদা বা মৌলিক বিশ্বাসের অংশ।
তিনি বলেন,
“উপমহাদেশের সব আলেম–ওলামার অবস্থান একই—যে কেউ যদি রাসূলুল্লাহ (সা.)–এর পর নবুওয়তের দাবি করে, সে ইসলামের বাইরে। এই ব্যাপারে আমাদের মাঝে কোনো মতপার্থক্য নেই।”
তার মতে, এই সম্মেলন শুধু বাংলাদেশেই নয়, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে মতাদর্শগত সংহতি আরও দৃঢ় করবে।
বাংলাদেশের প্রশংসা: উদ্যমী ও সাহসী জাতি
মাওলানা ফজলুর রহমান বাংলাদেশের জনগণকে “সক্রিয়, উদ্যমী ও আন্তরিক” হিসেবে উল্লেখ করে বলেন,
“বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভিত্তিক আন্দোলনে অত্যন্ত সচেতন। তারা আদর্শের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। সহিংসতা নয়, স্থিতিশীলতা ও সততার ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের অগ্রযাত্রা।”
তিনি বাংলাদেশের সামাজিক ও ধর্মীয় পরিবেশের প্রশংসা করে বলেন, পাকিস্তানের জনগণ বরাবরই বাংলাদেশিদের প্রতি আন্তরিক, এবং দুই দেশের মানুষের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও দৃঢ় হবে।
পাকিস্তানের জনগণের শুভেচ্ছা বার্তা বাংলাদেশিদের কাছে
পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন,
“আমরা শুধু একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসিনি। পাকিস্তানের জনগণের শুভেচ্ছা, আন্তরিকতা ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা নিয়ে এসেছি।”
তার মতে, দুই দেশের জনগণ সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও ঐতিহাসিকভাবে পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
বাংলাদেশ–পাকিস্তান সম্পর্ক: অতীতের অবসান, ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
অনেক বছর ধরে দুই দেশের সম্পর্ক মাঝে মাঝে উষ্ণ, আবার কখনো ঠাণ্ডা ছিল। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের ইতিহাস নিয়ে রাজনৈতিক অস্বস্তি বহুবার আলোচনায় এসেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাণিজ্য, জনসংযোগ, সাংস্কৃতিক বিনিময় ও কূটনৈতিক আলোচনায় নতুন গতি এসেছে।
১. বাণিজ্যিক সম্পর্ক
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য গত দশকে দ্বিগুণ হয়েছে।
বাংলাদেশ পাকিস্তানে রপ্তানি করছে:
- ওষুধ
- রেডিমেড গার্মেন্টস
- জুট ও জুটজাত পণ্য
- আইটি–সেবা
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আমদানি করছে:
- কাঁচামাল
- কেমিক্যাল
- কাগজ
- ফলমূল ও কৃষিপণ্য
যদিও এই বাণিজ্য সম্ভাবনার তুলনায় এখনও কম, উভয় দেশই চুক্তি সম্প্রসারণে আগ্রহী।
২. কূটনৈতিক যোগাযোগ
সম্প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে দুই দেশের প্রতিনিধিদের মাঝে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তান একাধিকবার বাংলাদেশে কূটনৈতিক উপস্থিতি বাড়ানোর আশা প্রকাশ করেছে।
৩. ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিনিময়
দুই দেশে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতিষ্ঠান, আলেম–ওলামার আদান–প্রদান এবং ইসলামী সেমিনারগুলোতে অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে।
এই সম্মেলনকে এই ধারাবাহিকতারই একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
দুই দেশের মানুষের মাঝে ঐক্যের বার্তা
মাওলানা ফজলুর রহমান বলেন,
“ঈমানের বন্ধন এমন একটি শক্তিশালী সুতো, যা কখনো কাটে না। আমরা একই ইতিহাসের অংশ, একই ভাষা পরিবারের মানুষ, একই সংস্কৃতির ধারা। সবচেয়ে বড় কথা—আমরা একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী।”
তিনি আশা করেন, এই সম্মেলন দুই দেশের সরকারের মধ্যেও নতুন আলোচনার পথ খুলে দেবে—বিশেষত বাণিজ্য, শিক্ষা, ধর্মীয় আদানপ্রদান এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে।
পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো
তার বক্তব্যে সবচেয়ে আলোচিত বাক্য ছিল—
“বাংলাদেশ যদি এক কদম এগোয়, পাকিস্তান দুই কদম এগোবে।”
এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি শুধু ধর্মীয় নয়, রাষ্ট্রিক পর্যায়েও সম্পর্ক উন্নয়নের বার্তা দেন।
অনেক বিশ্লেষকের মতে, এটি পাকিস্তানের তরফ থেকে একটি কূটনৈতিক সদিচ্ছার ইঙ্গিত।
বাংলাদেশের ভিতরে প্রতিক্রিয়া
সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার মানুষ রাজধানীতে জড়ো হয়। অনেক আলেম–ওলামা পাকিস্তান থেকে ডেলিগেশনের আগমনকে দক্ষিণ এশিয়ার ইসলামী ঐক্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনও বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বমঞ্চে ইসলামী ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, আর এই ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন দেশের ভাবমূর্তি আরও উন্নত করে।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন:
- এই সফর দুই দেশের মাঝে যোগাযোগের নতুন দরজা খুলতে পারে
- ধর্মীয় সম্পর্ক কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে সহায়ক হতে পারে
- দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতায় বাংলাদেশ–পাকিস্তান সহযোগিতা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে
অন্যদিকে কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে ইতিহাসের সমাধানসংক্রান্ত ইস্যুগুলোও আলোচনায় আনতে হবে।
আগামীর পথচলা: ঐক্য, সহযোগিতা ও ভ্রাতৃত্ব
মাওলানা ফজলুর রহমান বলেন,
“আমরা সবাই চাই বাংলাদেশ ও পাকিস্তান একে অপরের সঙ্গে নতুনভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলুক। মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়ুক, ভুল বোঝাবুঝি দূর হোক, সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হোক।”
তিনি আরও বলেন,
“আমরা একই উম্মাহর অংশ, এটি কখনো ভুলে গেলে চলবে না।”
এ ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও সফর দুই দেশের মানুষের মনেও নতুন আশার সঞ্চার করে।
MAH – 13828 I Signalbd.com



