বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধের বীরযোদ্ধা আব্দুল কাদের সিদ্দিকী। সাম্প্রতিক একটি ইউটিউব সাক্ষাৎকারে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের সভাপতি শেখ হাসিনাকে “পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি” বলে মন্তব্য করেছেন। তার এই বক্তব্য দেশজুড়ে নতুন করে আলোচনা সৃষ্টি করেছে।
কাদের সিদ্দিকী দীর্ঘদিন ধরে শেখ হাসিনার নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সমালোচক হলেও ব্যক্তিগতভাবে তার প্রতি শ্রদ্ধা–ভালবাসার কথা আগেও বলেছেন। তবে এবার তার বক্তব্যে এমন এক আবেগমিশ্রিত সুর পাওয়া গেছে, যা নতুন করে রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন তুলেছে—কাদের সিদ্দিকীর এই মূল্যায়ন কি শুধু আবেগের প্রকাশ, নাকি এর পেছনে রয়েছে আরও গভীর রাজনৈতিক পাঠ?
সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,
“শেখ হাসিনা আমার মায়ের মতো। পৃথিবীতে আমার মায়ের চাইতে সম্মানী আর কেউ নেই। আমি তাকে শতবার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছি—তা রাজদরবারে হোক, জনপথে হোক বা ঘরে। সেই সম্মানের জায়গাটা এখনো অটুট।”
ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও শ্রদ্ধার কথা প্রকাশ
কাদের সিদ্দিকী তার বক্তব্যে নিজের পরিবার-সংক্রান্ত কথাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তার বড় দুই ভাইবোন মারা গেছেন। ছোট বোন আছে তিনজন, কিন্তু কোনো বড় বোন ছিলেন না। সেই অভাবের জায়গায় শেখ হাসিনা তার জীবনে বড় বোনের মত জায়গা করে নিয়েছিলেন। তাই তার প্রতি শ্রদ্ধা–মমত্ববোধ ব্যক্তিগতভাবেই গভীর।
তার ভাষ্যমতে—
“আমার ভাইবোনদের যেভাবে ভালোবাসি, শেখ হাসিনাকেও সেভাবে ভালোবাসি। এই ভালোবাসায় কোনো পরিবর্তন হয়নি।”
রাজনৈতিক দূরত্বের কারণ ব্যাখ্যা
যদিও ব্যক্তিজীবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা আছে, তবুও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুজনের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে। সাক্ষাৎকারে তিনি পরিষ্কারভাবে জানান—
“তার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমার দূরত্ব আছে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দেশের প্রতিটি মানুষের প্রতি, এমনকি ভুলকারী মানুষের প্রতিও, তার দায়িত্ব ছিল। কিন্তু সেটা তিনি যথাযথভাবে উপলব্ধি করেননি।”
তিনি বিশেষভাবে অভিযোগ করেন—
শেখ হাসিনা প্রায় প্রতিটি বক্তৃতায় বিএনপি ও জামায়াতকে আক্রমণ করতেন, যা তার মতে প্রয়োজন ছিল না।
কাদের সিদ্দিকীর মন্তব্য:
“আমি বহুবার তাকে বলেছি, অন্তত ছয় মাস বক্তৃতায় বিএনপি-জামায়াতের নাম বাদ দিন। দেখবেন দেশে তাদের জনপ্রিয়তা কমবে। মানুষ অযৌক্তিক কথা পছন্দ করে না।”
বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়ে তার বক্তব্য
কাদের সিদ্দিকী মনে করেন, বিরোধী দল সবসময় সরকারের সমালোচনা করবে। এটি তাদের গণতান্ত্রিক দায়িত্ব।
তিনি বলেন—
“বিরোধী দলের কাজই হলো সরকারের ভুল তুলে ধরা, চাপ সৃষ্টি করা। সরকার চাইলে ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রতিবন্ধকতা দিতে পারে, কিন্তু অন্যায়ভাবে বাধা দেওয়ার এখতিয়ার নেই।”
তার মতে, শেখ হাসিনার শাসনামলে বিরোধী দলের কর্মকাণ্ড সীমিত হওয়ার কারণেও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগ—‘পলায়ন’ নয়, ‘রাষ্ট্রীয় পাঠানো’: কাদের সিদ্দিকী
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া নিয়ে গত কয়েক মাসে নানা আলোচনা হয়েছে। কেউ বলছেন তিনি পালিয়ে গেছেন, কেউ বলছেন তাকে জোর করে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।
কাদের সিদ্দিকী এই বিতর্কের বিষয়ে খুব সুস্পষ্ট মন্তব্য করেন:
“ব্যাকরণের দিক থেকেও ‘পালানো’ শব্দটি তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারতে পাঠানো হয়েছে।”
তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন:
– যদি তিনি পালাতে চাইতেন, তাহলে যাত্রীবাহী বিমানে উঠতেন।
– কিন্তু তিনি গেছেন সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর বিমানে।
– ভারতে পৌঁছেও সাধারণ বিমানবন্দরে নামেননি; নেমেছেন সামরিক বিমানঘাঁটিতে।
– তাই এটিকে ‘পলায়ন’ বলা ভুল।
এ বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ সাড়া ফেলেছে, বিশেষ করে সেই সব মহলে যারা শেখ হাসিনাকে ‘পলায়নকারী’ হিসেবে প্রচারণা চালিয়েছে।
আইনের ঊর্ধ্বে নয়—এই নীতিতে দৃঢ় কাদের সিদ্দিকী
কাদের সিদ্দিকী শাসনক্ষমতার প্রশ্নে সবসময় স্পষ্টভাষী। শেখ হাসিনার ব্যাপারেও তিনি একই অবস্থান নেন।
তিনি বলেন—
“তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আসবে, তা আইন অনুযায়ী বিচার হতে হবে। আমি কখনোই মানব না যে তিনি আইনের ঊর্ধ্বে। আবার এটাও সমর্থন করব না যে কেউ আইনবহির্ভূতভাবে তাকে প্রতিশোধমূলক শাস্তি দেবে।”
তার এই মন্তব্য রাজনৈতিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ বলে অনেক বিশ্লেষকের মত।
শেখ হাসিনা সম্পর্কে তার আবেগ—রাজনীতির বাইরে এক ব্যক্তিগত সম্পর্ক
যদিও রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে দুজন দীর্ঘদিন ভিন্ন পথে হেঁটেছেন, তবুও শেখ হাসিনার প্রতি তার ব্যক্তিগত সম্মান কখনোই কমেনি—এটি তার বক্তব্যে পরিস্কার।
তিনি বলেন—
“আমি আগেও তাকে মায়ের মতো সম্মান করেছি, এখনো করি। এই সম্মান রাজনীতির চেয়ে বড়।”
অনেকেই বলছেন—কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্যে যেন অতীতের সেই রাজনৈতিক সৌজন্য সংস্কৃতির প্রতিফলন দেখা গেছে, যা বর্তমান রাজনীতিতে খুব কমই দেখা যায়।
বিস্তৃত প্রেক্ষাপট: কেন কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্য এখন গুরুত্বপূর্ণ?
এই বক্তব্য এমন সময়ে এসেছে, যখন—
– শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন
– দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
– বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নতুন জোট গঠনের চিন্তাভাবনা করছে
– নতুন নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক পুনর্গঠনের আলোচনায় দেশ উত্তপ্ত
এই প্রেক্ষাপটে কাদের সিদ্দিকীর মতো অভিজ্ঞ ও সম্মানিত নেতার এমন মন্তব্য রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন বিশ্লেষণের ক্ষেত্রও তৈরি করেছে।
অতীত সম্পর্কের চাপান-উতোর
কাদের সিদ্দিকী একসময় আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার সম্মানও অটুট।
কিন্তু রাজনীতির নানা বাঁকে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরে যান, গঠন করেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ।
তবুও শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সঙ্গে তার একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে বরাবরই কৌতূহলের বিষয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া কী?
বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের মতে—
– কাদের সিদ্দিকী মূলত আবেগঘন ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ করেছেন
– তবে এর রাজনৈতিক তাৎপর্যও রয়েছে
– বর্তমান রাজনৈতিক সংকটে এমন মন্তব্য ভবিষ্যত সমীকরণে প্রভাব ফেলতে পারে
– শেখ হাসিনার ‘পলায়ন’ বিতর্কে তার ব্যাখ্যা ঘটনার ভিন্ন দৃষ্টিকোণ এনেছে
জনসাধারণ কী বলছে?
– কেউ তার বক্তব্যকে মানবিকতার উদাহরণ হিসেবে দেখছেন
– কেউ এটি রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বলছেন
– আবার সমালোচকরা বলছেন, এটি সময়োপযোগী মন্তব্য নয়
তবে যে মতই হোক, একথা নিশ্চিত—কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্যের পর নতুন করে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
শেখ হাসিনা নিয়ে কাদের সিদ্দিকীর এই বক্তব্য শুধুই একটি মন্তব্য নয়—এটি এক রাজনীতিকের ব্যক্তিগত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ, দীর্ঘদিনের সম্পর্কের সম্মান, এবং দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বাস্তবতার মিলিত রূপ।
রাজনীতির মাঠে মতপার্থক্য থাকতেই পারে, কিন্তু ব্যক্তিগত সম্মান ও মানবিক মূল্যবোধ অটুট থাকতে পারে—এ বক্তব্য সেই সত্যটাই নতুন করে স্পষ্ট করেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি ক্রমেই আরও জটিল হতে থাকলেও এমন মূল্যবান ও ভারসাম্যপূর্ণ মন্তব্যই রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে আরও সুস্থ পথে পরিচালিত করতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
MAH – 13818 I Signalbd.com



