রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অবস্থিত জেনেভা ক্যাম্প এখন অবৈধ মাদক ও সশস্ত্র অপরাধীদের প্রধান কেন্দ্র। পুলিশের অভিযানে ধরা পড়েছে ৩৫টি ককটেল ও বিপুল অস্ত্র, তবে মূল শীর্ষ দুষ্কৃতকারীরা এখনও দখলকৃত এলাকায় সক্রিয়।
মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পকে রাজধানীর অপরাধ জগতের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পাওয়া যায়। এখানে সশস্ত্র গ্যাং ও মাদক কারবারের সাথে যুক্ত দেড় হাজারেরও বেশি ব্যক্তি বসবাস করছেন। সম্প্রতি পুলিশের অভিযান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৩৫টি ককটেল ও বিভিন্ন ধরনের বোমা তৈরির সরঞ্জাম। তবে ক্যাম্পের মূল শীর্ষ অপরাধী এখনো দখলকৃত এলাকায় সক্রিয়।
জেনেভা ক্যাম্পে পুলিশের অভিযান
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার মো. ইবনে মিজান জানিয়েছেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শুক্রবার সন্ধ্যায় অভিযান চালিয়ে ক্যাম্পের বিভিন্ন ঘর থেকে ৩৫টি ককটেল ও ককটেল তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনায় তিনজন ককটেল প্রস্তুতকারককে আটক করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত ককটেলগুলি পরে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে।
মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী রফিক বলেন, “ক্যাম্পে ককটেল তৈরি করা হচ্ছিল—এমন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়েছে। মূল শীর্ষ অপরাধীরা পালিয়ে গেছে।” পুলিশ জানিয়েছে, অভিযানের সময় ক্যাম্পে অতিরিক্ত নিরাপত্তা মোতায়েন করা হয়েছিল।
ক্যাম্পের অপরাধমূলক অবকাঠামো
জেনেভা ক্যাম্পের এলাকাটি ৯টি সেক্টর ও ৩০টি সরু গলিতে বিভক্ত। এখানে বসবাসকারী বাসিন্দাদের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। প্রায় ৩শ’ সশস্ত্র দুষ্কৃতকারী ও দেড় হাজারের বেশি ব্যক্তি বিভিন্ন অপরাধ ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।
একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্যাম্পে মূলত দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যাং রয়েছে—ভূঁইয়া সোহেল ও চুয়া সেলিম। ভূঁইয়া সোহেল গ্রুপের হাতে আটটি অস্ত্র রয়েছে, যার মধ্যে তিনটি বিদেশি। চুয়া সেলিমের গ্যাংও চারটি অস্ত্র ব্যবহার করছে। গ্যাংগুলো ক্যাম্পের বিভিন্ন সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করে, এবং প্রত্যেকের পাশে সহযোগী ও উপ-নেতাদের একটি জাল রয়েছে।
সাম্প্রতিক সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা
গত কয়েক মাসে মাদক ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ক্যাম্পে সশস্ত্র সংঘর্ষ বৃদ্ধি পেয়েছে। আগস্ট মাসের পর থেকে অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছেন, আহতের সংখ্যা কয়েকশো। সংঘর্ষের সময় পিস্তল, শটগান ও ককটেল ব্যবহার করা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, প্রতিপক্ষরা হত্যার পর উল্লাস ও উৎসবের মতো আচরণ করছে। এর ফলে সাধারণ নাগরিক ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরাও আহত হয়েছেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, একটি ডাস্টবিনে রাখা পরিত্যক্ত বোমা বিস্ফোরণে তিন পরিচ্ছন্নতাকর্মী আহত হন।
মাদক কারবার ও শীর্ষ নেতৃত্ব
জেনেভা ক্যাম্পে মাদক ব্যবসার ক্ষেত্রে চুয়া সেলিম ও ভূঁইয়া সোহেল গ্রুপের আধিপত্য রয়েছে। এছাড়া শামিম ওরফে লাড্ডুর ছেলে পারভেজ ককটেল ও বোমা তৈরির সরবরাহ নিশ্চিত করছে। ক্যাম্পে মাদক কেনা-বিক্রি ও সেবন নির্বিঘ্নে চলে, যা রাজধানীর অন্যান্য এলাকায় মাদক কারবারের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এই দুই শীর্ষ গ্যাং এবং তাদের সহযোগীরা ক্যাম্পের ভেতরে ও বাইরে যেকোনো ধরনের অপরাধে সক্রিয়। তারা এলাকায় নিজেদের দখল ধরে রাখার জন্য সশস্ত্র লড়াই চালাচ্ছে।
পুলিশের পদক্ষেপ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
ডিএমপি জানিয়েছে, জেনেভা ক্যাম্পে পুলিশের দুটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। নিয়মিত অভিযান ও অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েনের মাধ্যমে অপরাধ দমনের চেষ্টা চলছে। এছাড়া স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বজায় রেখে অভিযানের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
পুলিশ আশা করছে, ধীরে ধীরে মাদক ব্যবসা ও ক্যাম্পের অপরাধমূলক কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব হবে। বিশেষ অভিযান ও বোমা নিষ্ক্রিয়করণের মাধ্যমে পুলিশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা হয়েছে।
বিশ্লেষণ
জেনেভা ক্যাম্পের পরিস্থিতি রাজধানীর অপরাধ ও মাদক নিয়ন্ত্রণে একটি চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন গ্যাং এখানে প্রভাব বিস্তার করছে। পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর অভিযান কার্যকর হলেও মূল শীর্ষ নেতাদের ধরা কঠিন। নিরাপত্তা জটিলতা এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভূগোল অভিযানের কার্যকারিতা সীমিত করছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুধুমাত্র অভিযানে নির্ভর করা যাবে না। স্থানীয় জনগণের সচেতনতা ও দীর্ঘমেয়াদী নজরদারি ব্যবস্থা অপরিহার্য।
জেনেভা ক্যাম্প এখন ঢাকা শহরের অপরাধ জগতের অন্যতম হেডকোয়ার্টার। পুলিশের অভিযানে কিছু অগ্রগতি সত্ত্বেও ক্যাম্পের মূল শীর্ষ অপরাধীরা সক্রিয়। মাদক ব্যবসা ও সশস্ত্র অপরাধ দমনের জন্য সতর্ক পদক্ষেপ ও নিয়মিত অভিযান চালানো অপরিহার্য।
এম আর এম – ২২৫৪,Signalbd.com



