অর্থনীতি

সামাজিক সুরক্ষায় অর্ধেকের বেশি বরাদ্দ পেনশন, সুদ, ভবন নির্মাণ, যন্ত্রপাতি কেনায়: টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন

বাংলাদেশের সামাজিক সুরক্ষা বাজেটের বড় একটি অংশ প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র ও আর্থিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য নয়। সম্প্রতি প্রকাশিত অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণবিষয়ক টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দের অর্ধেকের বেশি অর্থ পেনশন, সুদ পরিশোধ, ভবন নির্মাণ এবং যন্ত্রপাতি কেনায় ব্যয় করা হচ্ছে, যা সরাসরি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপকারে আসছে না।

বাজেটের বাস্তবতা

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে মোট ১ লাখ ৩৬ হাজার ২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই অর্থ ১৪০টি ভিন্ন ভিন্ন খাতে ব্যয় করা হবে। তবে টাস্কফোর্সের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এর মধ্যে ৭২ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এমন ২১টি খাতে, যা জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রের (NSPSS) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

সর্বাধিক বরাদ্দ পেনশন খাতে, যা ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ ছাড়াও কৃষি খাতে ভর্তুকি বাবদ ১৭ হাজার কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধে ৮ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এই খাতগুলো সরাসরি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নয়, ফলে প্রকৃত সামাজিক সুরক্ষা প্রদানে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।

অসামঞ্জস্যপূর্ণ খরচের উদাহরণ

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সামাজিক সুরক্ষা খাতের নামে বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, যেমন:

  • জয়িতা ফাউন্ডেশনের ভবন নির্মাণ
  • ভূমিকম্প ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় যন্ত্রপাতি কেনা
  • জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কল্যাণ অনুদান
  • ইলিশ সম্পদ উন্নয়নে প্রযুক্তি কর্মসূচি
  • গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিনা মূল্যে বই বিতরণ

এই খরচগুলো সামাজিক সুরক্ষা হিসেবে দেখানো হলেও বাস্তবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সরাসরি উপকৃত করে না। ফলে দারিদ্র্য হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা রাখছে না।

টাস্কফোর্সের সুপারিশ

টাস্কফোর্সের প্রধান, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ জানান, “সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বিনিয়োগ বেশি দেখানোর জন্য এই ধরনের খাতে অর্থ বরাদ্দ করা হয়। প্রকৃত সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে সঠিকভাবে বরাদ্দ পৌঁছানো জরুরি।”

তিনি আরও বলেন, সামাজিক সুরক্ষার সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করা প্রয়োজন, যাতে প্রকৃত সুবিধাভোগীরা সঠিকভাবে বাছাই করা যায়। পেনশন এবং সঞ্চয়পত্রের সুদ সামাজিক সুরক্ষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা অনুচিত।

রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতির অভিযোগ

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রাজনৈতিক বিবেচনা ও দুর্নীতির মাধ্যমে অনেক অনুপযুক্ত ব্যক্তি সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা পাচ্ছেন। এতে প্রকৃত দরিদ্র জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হচ্ছে। টাস্কফোর্সের মতে, প্রায় ৫৪ শতাংশ দরিদ্র পরিবার এখনো কোনো ধরনের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় নেই।

অন্যদিকে, ৬২ শতাংশ সুবিধাভোগী পরিবার গরিব নয়, অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রভাব বা প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে তারা এই সুবিধা পাচ্ছে। যদি এই ত্রুটিগুলো দূর করা যায়, তবে অতিরিক্ত ১১ লাখ মানুষকে অতিদারিদ্র্য থেকে এবং ২৫ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনা সম্ভব।

গবেষকদের মতামত

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির দুর্বলতা দূর করা জরুরি। পেনশন স্কিমের মতো খাতগুলো সামাজিক সুরক্ষা হিসেবে রাখার প্রয়োজন নেই। প্রকৃত দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে স্বচ্ছতার সাথে সুবিধা প্রদান করা উচিত।”

তিনি আরও বলেন, “বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সেবা না দিয়ে একটি একক কাঠামোর অধীনে সামাজিক সুরক্ষা সেবা প্রদান করলে প্রশাসনিক দুর্বলতা হ্রাস পাবে এবং সঠিক মানুষ সুবিধা পাবে।”

সামাজিক সুরক্ষার ভবিষ্যৎ

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণের উপর নির্ভরশীল ছিল। ২০১৫ সালে প্রণীত জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রের (NSPSS) মাধ্যমে এই নীতিতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়। তবে এখনো অনেক সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে।

টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে যে, ২০২৬ সালে NSPSS-এর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে একটি সমন্বিত সামাজিক সুরক্ষা কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা প্রকৃত দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

উপসংহার

বাংলাদেশের সামাজিক সুরক্ষা বাজেটের এই বিশ্লেষণ দেখায় যে, বরাদ্দের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ নীতির কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, দারিদ্র্য বিমোচন এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং সঠিক নীতিমালা প্রয়োগের বিকল্প নেই। টাস্কফোর্সের সুপারিশ অনুযায়ী, এখনই সময় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিকে কার্যকরভাবে ঢেলে সাজানোর।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button