বিশ্ব

প্রতি ১০ আফগান পরিবারের নয়টিই না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে: ইউএনডিপি

Advertisement

আফগানিস্তানের পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্যপীড়িত এলাকাগুলোতে প্রতি ১০টি পরিবারের মধ্যে ৯টি পরিবারই এখন ক্ষুধায় দিন কাটাচ্ছে বা ঋণের ভারে জর্জরিত। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে এমন ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটির অর্থনৈতিক সংকট, পুনর্বাসনের ব্যর্থতা এবং বিদেশি সহায়তার ঘাটতির কারণে আফগান জনগণের জীবন আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

ইউএনডিপির জরিপ অনুযায়ী, আফগানিস্তানের গৃহহীন বা বাস্তুচ্যুত জনগণের অধিকাংশই এখন মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ। ৪৮ হাজার পরিবারের ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, ৯০ শতাংশেরও বেশি পরিবার ঋণে ডুবে আছে, এবং প্রতি পরিবারের গড় ঋণের পরিমাণ ৩৭৩ থেকে ৯০০ মার্কিন ডলার—যা দেশটির গড় মাসিক আয়ের পাঁচগুণেরও বেশি।

বিদেশি সহায়তা কমে যাওয়ায় গভীর সংকটে তালেবান প্রশাসন

২০২১ সালে তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই আফগানিস্তানে পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও বৈদেশিক ত্রাণ সহায়তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। আগে যে পরিমাণ আন্তর্জাতিক তহবিল ও মানবিক সহায়তা পাওয়া যেত, তা এখন প্রায় অর্ধেকেরও কম।
এছাড়া দেশটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একের পর এক ভূমিকম্প, বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব দুর্যোগে লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে, যাদের অনেকেই এখনো পুনর্বাসিত হতে পারেননি।

পাশাপাশি পাকিস্তান ও ইরান থেকে বিপুল সংখ্যক শরণার্থী দেশে ফিরতে বাধ্য হওয়ায় সমস্যা আরও জটিল হয়েছে। ইউএনডিপির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের পর থেকে প্রায় ৪৫ লাখ আফগান দেশে ফিরেছে; যার মধ্যে চলতি বছরেই ১৫ লাখ মানুষ বাধ্য হয়ে ইরান ও পাকিস্তান থেকে ফিরে এসেছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে তালেবান প্রশাসন।

বাসস্থান ও মৌলিক সেবায় ভয়াবহ অবস্থা

ইউএনডিপির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাড়িভাড়া তিনগুণ বেড়ে যাওয়ায় ফেরত আসা পরিবারগুলো ভালো বাসস্থান খুঁজে পাচ্ছে না। অনেকেই এখন তাঁবু বা জরাজীর্ণ ঘরে বসবাস করছে।
পশ্চিম আফগানিস্তানের ইনজিল ও গুজারা জেলার বেশিরভাগ মানুষই শীতের মধ্যে ত্রিপল বা খোলা জায়গায় রাত কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। জরিপে দেখা যায়, অর্ধেকেরও বেশি পরিবার পর্যাপ্ত জায়গা বা বিছানার অভাবের অভিযোগ জানিয়েছে।

এছাড়া ১৮ শতাংশ পরিবার জানায়, তারা গত এক বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অনেক এলাকায় এখনো স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নিরাপদ পানির অভাব প্রকট। কিছু অঞ্চলে বেকারত্বের হার ৯৫ শতাংশে পৌঁছেছে।

আন্তর্জাতিক সহায়তার আহ্বান

আফগানিস্তানে ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টিফেন রড্রিকস বলেন, “আয়ের সুযোগ, মৌলিক পরিষেবা, আবাসন ও সামাজিক সংহতিকে কাজে লাগিয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় চাপ কমানো এবং পুনর্বার বাস্তুচ্যুতির ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব।”
তিনি আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী ও মানবিক সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আফগান জনগণ এখন এক ভয়াবহ দুর্দশার মধ্যে রয়েছে। তাদের সহায়তা না করলে মানবিক বিপর্যয় আরও বিস্তৃত হবে।

রড্রিকসের মতে, জরুরি সহায়তা এখন শুধু খাদ্য নয়, বরং জীবিকা পুনর্গঠনের সুযোগ সৃষ্টি করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও শিক্ষাক্ষেত্রে পুনঃবিনিয়োগ ছাড়া আফগান অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে না।

বৈদেশিক তহবিল সংকটে জাতিসংঘের উদ্যোগ ব্যাহত

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে আফগানিস্তানের জন্য যে ৩.১ বিলিয়ন ডলার সহায়তা চাওয়া হয়েছিল, তার অর্ধেকেরও কম অর্থ এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে।
ফলে ইউএনডিপি ও অন্যান্য মানবিক সংস্থা তাদের বেশ কয়েকটি প্রকল্প স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছে। বিশেষত নারী স্বাস্থ্য, শিশু পুষ্টি ও শিক্ষায় বরাদ্দ কমে গেছে, যা দীর্ঘমেয়াদে প্রজন্মগত সংকট সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

মানবিক সংকটের পেছনের কারণ: রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বৈষম্য

বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগানিস্তানের বর্তমান সংকট কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং গভীর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ফল। তালেবান সরকারের নারী শিক্ষা ও কর্মসংস্থানবিরোধী নীতি আন্তর্জাতিক সহায়তা হ্রাসে বড় ভূমিকা রেখেছে।
বহু দেশ এখনো তালেবান প্রশাসনকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি, ফলে আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং চ্যানেল ও উন্নয়ন তহবিলে প্রবেশাধিকার সীমিত। এর ফলে সরকারি কর্মসূচি স্থবির হয়ে পড়েছে এবং স্থানীয় প্রশাসন পর্যায়ে দুর্নীতি বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞ মতামত: “দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিতে গোটা অঞ্চল”

দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, আফগানিস্তানের এই পরিস্থিতি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হয়ে উঠছে।
বিশ্লেষক হামিদ নাসির বলেন, “যখন একটি দেশের ৯০ শতাংশ পরিবার খাদ্য ঘাটতিতে ভোগে, তখন সীমান্ত অতিক্রম করে অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন শুরু হয়। এটি শুধু আফগানিস্তান নয়, পাকিস্তান, ইরান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর জন্যও বিপজ্জনক।”

তিনি আরও বলেন, “দ্রুত মানবিক সহায়তা এবং আন্তর্জাতিকভাবে সমন্বিত পুনর্বাসন কর্মসূচি না নিলে আফগানিস্তান দ্বিতীয় সিরিয়া হয়ে উঠতে পারে।”

ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা

বিশ্লেষকরা মনে করেন, আফগানিস্তান এখন এক গভীর মানবিক সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে। তালেবান প্রশাসনের উচিত হবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানো এবং মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনা।
ইউএনডিপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদি জরুরি খাদ্য, আশ্রয় ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে শীত মৌসুমে আরও লক্ষাধিক আফগান অনাহারে প্রাণ হারাতে পারে।

আফগানিস্তানের পরিস্থিতি এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে মানবিক সহায়তা ও রাজনৈতিক সমাধান—দুটিরই সমন্বিত প্রয়াস ছাড়া কোনো স্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব নয়। প্রতি ১০ পরিবারের মধ্যে ৯টি অনাহারে দিন কাটানো একটি ভয়াবহ বাস্তবতা, যা বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে এক কঠিন প্রশ্ন রেখে গেছে—আফগান জনগণকে কে রক্ষা করবে?

এম আর এম – ২২০৬,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button