দেশজুড়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব যেন থামছেই না। মাত্র ২৪ ঘণ্টায় প্রাণ হারিয়েছেন আরও পাঁচজন। একই সময়ে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১,১৩৯ জন ডেঙ্গু রোগী। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৮১ হাজার ৭৭৩ জন, আর প্রাণ হারিয়েছেন ৩২৩ জন।
১২ নভেম্বর (বুধবার) প্রকাশিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ অ্যান্ড ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দৈনিক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আক্রান্তদের মধ্যে রাজধানী ঢাকা এখনও সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। তবে এবার রাজধানীর বাইরে বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতেও ডেঙ্গুর প্রকোপ ক্রমে বাড়ছে, যা উদ্বেগজনক।
বিভাগভিত্তিক ডেঙ্গু আক্রান্তের সর্বশেষ চিত্র
গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১,১৩৯ জনের মধ্যে সর্বাধিক রোগী পাওয়া গেছে ঢাকায়।
- ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায়: ২৫৪ জন
- ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে: ১৪৩ জন
- ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলায়: ২২৩ জন
- চট্টগ্রাম বিভাগে: ১১৫ জন
- বরিশাল বিভাগে: ১৭৯ জন
- খুলনা বিভাগে: ৮৯ জন
- রাজশাহী বিভাগে: ৪৬ জন
- ময়মনসিংহ বিভাগে: ৮২ জন
- রংপুর বিভাগে: ৫ জন
- সিলেট বিভাগে: ৩ জন
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এবার ডেঙ্গুর বিস্তার কেবল শহরেই নয়, গ্রামীণ ও উপশহর এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে রোগী শনাক্ত ও চিকিৎসা কার্যক্রম আরও জটিল হয়ে উঠছে।
ডেঙ্গুর বার্ষিক পরিসংখ্যান: বছরভিত্তিক তুলনা
২০২৫ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৮১ হাজার ছাড়িয়েছে। গত বছরের তুলনায় এ সংখ্যা কম হলেও মৃত্যুর হার উদ্বেগজনকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পূর্ববর্তী তথ্য অনুযায়ী:
- ২০২৪ সালে:
- আক্রান্ত: ১,০১,২১৪ জন
- মৃত্যু: ৫৭৫ জন
- ২০২৩ সালে:
- আক্রান্ত: ৩,২১,১৭৯ জন
- মৃত্যু: ১,৭০৫ জন
অর্থাৎ, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ডেঙ্গু পরিস্থিতি দেখেছিল। তবে ২০২৫ সালেও পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
ডেঙ্গুর কারণ ও বিস্তার: কেন বাড়ছে সংক্রমণ
ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশা (বিশেষত Aedes aegypti ও Aedes albopictus) সাধারণত পরিষ্কার, স্থির পানিতে বংশবিস্তার করে।
রাজধানীর বাসাবাড়ি, নির্মাণাধীন ভবন, পরিত্যক্ত টায়ার, ফুলের টব বা ফ্রিজের ট্রে—এসব জায়গায় সামান্য পানি জমে থাকলে সেখানে এডিস মশা জন্ম নিতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কিছু প্রধান কারণ ডেঙ্গুর বিস্তার বাড়িয়ে দিচ্ছে—
১. আবহাওয়ার পরিবর্তন ও দীর্ঘায়িত বর্ষা মৌসুম
২. সঠিকভাবে মশা নিধন কার্যক্রম না হওয়া
৩. জনসচেতনতার ঘাটতি
৪. শহরে অতিরিক্ত বর্জ্য ও পানি নিষ্কাশনের সমস্যার কারণে মশার প্রজনন বৃদ্ধি
রাজধানীতে মশা নিয়ন্ত্রণে নতুন চ্যালেঞ্জ
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রতিদিন মশা নিধন কর্মসূচি পরিচালনা করছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি যথেষ্ট নয়।
মশার লার্ভা নষ্ট না করে কেবল প্রাপ্তবয়স্ক মশা ধ্বংস করলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন,
“এডিস মশা নিধনের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো লার্ভা ধ্বংস করা। জনগণ নিজের ঘরবাড়ি ও আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখলে ডেঙ্গুর ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব।”
চিকিৎসা ব্যবস্থার অবস্থা: হাসপাতালগুলোতে চাপ বাড়ছে
দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু ও প্রবীণ রোগীদের অবস্থা তুলনামূলক জটিল।
হাসপাতালগুলোতে এখনো পর্যাপ্ত বেড ও রক্ত সরবরাহ বজায় থাকলেও, চিকিৎসকরা বলছেন—যদি সংক্রমণ আরও বাড়ে, তবে হাসপাতাল ব্যবস্থা চাপে পড়বে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক জানান,
“অনেক রোগী দেরিতে হাসপাতালে আসছেন। ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলেই পরীক্ষা ও চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।”
ডেঙ্গুর লক্ষণ ও সতর্কতা
ডেঙ্গুর প্রধান লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- হঠাৎ উচ্চ জ্বর
- মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা
- শরীরে র্যাশ বা লাল দাগ
- পেশি ও জয়েন্টে ব্যথা
- বমি বমি ভাব ও ক্ষুধামন্দা
- রক্তপাত (গুরুতর অবস্থায়)
চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিচ্ছেন, জ্বর তিন দিনের বেশি স্থায়ী হলে অবশ্যই ডেঙ্গু পরীক্ষা (NS1 antigen বা CBC) করাতে হবে।
জনসচেতনতা ও প্রতিরোধে করণীয়
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো জনগণের অংশগ্রহণ।
নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয় তুলে ধরা হলো—
১. সপ্তাহে অন্তত একবার বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার করুন
২. ফুলের টব, পাত্র বা পানির বোতলে পানি জমতে দেবেন না
৩. ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করুন
৪. স্কুল, অফিস ও নির্মাণাধীন ভবনে নিয়মিত মশা নিধন করুন
৫. শিশুদের খোলা জায়গায় খেলতে পাঠানোর আগে সাবধানতা অবলম্বন করুন
সরকারের পদক্ষেপ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, ডেঙ্গু মোকাবিলায় সারাদেশে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যৌথভাবে কাজ করছেন।
এছাড়া উপজেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা ও চিকিৎসা প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও জোরদার করা হয়েছে।
সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন,
“ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কেবল সরকারি উদ্যোগে সম্ভব নয়। স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করেই এই সংকট মোকাবিলা করতে হবে।”
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আহ্বান
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু এখন কেবল একটি মৌসুমি রোগ নয়, বরং জনস্বাস্থ্য সংকটে রূপ নিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ণ ও জনঘনত্ব বৃদ্ধির কারণে আগামী বছরগুলোতেও এই ঝুঁকি অব্যাহত থাকতে পারে।
তাদের পরামর্শ—
- দীর্ঘমেয়াদি ভেক্টর কন্ট্রোল প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করা
- প্রতিটি ওয়ার্ডে নিয়মিত লার্ভা জরিপ করা
- স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ডেঙ্গু সচেতনতা ক্লাস চালু করা
বাংলাদেশে ডেঙ্গু এখন এক বাস্তবতা, যা থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রয়োজন যৌথ সচেতনতা, দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং ধারাবাহিক কর্মপরিকল্পনা।
ডেঙ্গুর প্রকোপ ঠেকাতে সরকার, সিটি কর্পোরেশন এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া বিকল্প নেই।
প্রতিদিনের ছোট ছোট সতর্কতাই হতে পারে প্রাণ বাঁচানোর বড় পদক্ষেপ।
MAH – 13772 I Signalbd.com



