বিশ্ব

দাড়ি রেখে ইতিহাসে স্থান করে নিতে চলেছেন জোহরান মামদানি

Advertisement

নিউইয়র্ক সিটি এবার শুধু প্রথম মুসলিম মেয়রই পাচ্ছে না, বরং এটি হচ্ছে শহরের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়। জোহরান মামদানি নবনির্বাচিত মেয়র হিসেবে নেমেছেন একাধিক দিক থেকে ইতিহাস গড়ার মিশনে। তিনি শহরের প্রথম দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত, প্রথম আফ্রিকান বংশোদ্ভূত, এবং এক শতাব্দীর বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে তরুণ মেয়র।

নবনির্বাচিত মেয়র হিসেবে জোহরানের চেহারার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তার দাড়ি। যদি অভিষেকের আগে হঠাৎ করে চুল বা দাড়ি কাটা না হয়, তাহলে তিনি ১৯১৩ সালে মারা যাওয়া উইলিয়াম জে গেনরের পর নিউইয়র্কের প্রথম শ্মশ্রুমণ্ডিত মেয়র হবেন। যদিও পুরোপুরি নিশ্চিত করে বলা যায় না, তবে মেয়রদের অফিসিয়াল প্রতিকৃতিতে দেখা যায়, সাধারণত দাড়ি–গোঁফ ছাড়া সকলেই। শুধু ডেভিড ডিঙ্কিন্সের গোঁফ ছিল ব্যতিক্রম।

জোহরানের দাড়ি দেখতে যেমন গেনরের মতো, তেমনি এর সাংকেতিক গুরুত্ব একেবারেই আলাদা। গেনর ১৯০৯ সালে নির্বাচিত হন বয়সে ৬০, ধূসর-সাদা দাড়ি আর সিল্ক টুপি পরিধান করতেন, যা তাকে পরিণত ও মর্যাদাপূর্ণ রাজনীতিক হিসেবে উপস্থাপন করত। সেই সময়ের সমাজে যারা ভ্যানডাইক দাড়ি রাখতেন, তাঁরা সাধারণত ব্যবসায়ী, রাজনীতিক বা সমাজের উচ্চ মর্যাদার ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত হতেন।

তবে জোহরানের দাড়ি একেবারে আলাদা অর্থ বহন করে। ২০১৩ সালে তিনি লিখেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র এক বছর আগে তিনি দাড়ি রাখতে শুরু করেন। এটি ছিল একধরনের প্রতীকী প্রতিবাদ। সেই সময়ে প্রচলিত ধারণা ছিল, বাদামি চামড়ার মানুষের দাড়ি মানেই ‘সন্ত্রাসী’। জোহরান নিজে এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন।

জোহরান এখন ৩৪ বছরের তরুণ, মিলেনিয়াল প্রজন্মের প্রতিনিধি। তার দাড়ি যেন পুরনো রাজনৈতিক কাঠামো ভাঙার প্রতীক। এটি বর্তমান মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বা ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়রের দাড়ির মতো নয়। জোহরান একজন বাদামি চামড়ার মুসলিম হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে দাড়ি রাখার সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বুঝতে পারেন।

প্রারম্ভিক জীবন ও দাড়ির গুরুত্ব

জোহরান মামদানির কলেজ জীবনও তার দাড়ির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। ২০১৩ সালে মেইনের বোডউইন কলেজে শেষ বর্ষে, তিনি ‘বিয়ার্ডেড ইন কায়রো’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। সেখানে তিনি কায়রোতে পড়াশোনার সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। সে সময় মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন চলছিল।

প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, “আমার দাড়ি ঘন ও কালো করে দেখানো—বর্ণবাদী ধারণাকে উসকে দেয়। এটি আমাকে হুমকিস্বরূপ দেখানোর চেষ্টা। কারণ, অ্যান্ড্রু কুমো এবং তাঁর ব্যর্থ প্রচারণা ধরে রাখার চেষ্টা করা দাতারা ভয় পেয়েছেন।”

জোহরান যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে লক্ষ্য করেন, স্থানীয়রা তাকে ইসলামপন্থী হিসেবে বিবেচনা করছে। এজন্য তিনি দাড়ি কাটতে নাপিতের দোকানে যান। তিনি লিখেছেন, “আমি তখন নিজেকে ভাবছিলাম যে যুক্তরাষ্ট্রে ১১ সেপ্টেম্বর হামলার পর যেসব বাদামি নাগরিক দাড়ি কেটে ফেলেছিলেন, তাঁদের একজন হিসেবে আমি এখন অবস্থান করছি।”

এরপর থেকে জোহরান প্রায় সবসময় দাড়ি রেখেছেন। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ২০২২ সালে, যখন তিনি নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্য পরিষদ সদস্য হিসেবে প্রথম মেয়াদে ছিলেন, তখন কিছুদিন শুধু গোঁফ রেখেছিলেন। এরপর আবার পূর্ণ দাড়ি রাখেন।

রাজনৈতিক প্রচারণায় দাড়ির প্রভাব

মেয়র নির্বাচনের প্রচারে প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ড্রু কুমোর সমর্থকরা জোহরানের দাড়িকে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। জুন মাসে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারির সময়, কুমো সমর্থক একটি সুপার পিএসি জোহরানের ছবিতে দাড়ি আরও ঘন ও কালো দেখিয়ে প্রচারণা চালায়।

জোহরান ও তার সমর্থকরা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানান। জোহরান বলেন, “আমার দাড়ি ঘন ও কালো করে দেখানো বর্ণবাদী ধারণাকে উসকে দেয়। এটি আমাকে হুমকি হিসেবে দেখানোর এক চেষ্টা।”

দাড়ি এবং ব্যক্তিগত পরিচয়

জোহরানের দাড়ি শুধু একটি স্টাইল নয়, এটি তার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিচয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি তার মিলেনিয়াল প্রজন্মের ভাবনা, অভিজ্ঞতা, এবং বৈচিত্র্যকে তুলে ধরে। এছাড়া এটি তার নেতৃত্বের অনন্যতা এবং পুরনো রাজনৈতিক কাঠামো ভাঙার অঙ্গীকারের প্রতীক।

জোহরান বলেন, “আমার দাড়ি আমার ইতিহাস, আমার সংস্কৃতি, এবং আমার স্বতন্ত্র পরিচয়ের অংশ। এটি আমাকে শুধুমাত্র একটি রাজনীতিক নয়, বরং এক নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরে।”

মুসলিম সম্প্রদায় ও ভোট

নিউইয়র্কে মুসলিম সম্প্রদায়ের ভোট জোহরানের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। নবনির্বাচিত মেয়র হিসেবে জোহরান ৯৭ শতাংশ মুসলিম ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। এটি প্রমাণ করে, মুসলিম ভোটাররা তার নেতৃত্বে গভীর আস্থা রাখেন। যদিও ভারতের মুসলিমরা তার জয়ের খুশি প্রকাশ করেছেন, বিজেপি-সমর্থকরা তুলনামূলকভাবে চুপ থেকেছেন।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ এবং আশা

জোহরান মামদানির মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া মানে শুধু রাজনৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং একটি নতুন ইতিহাসের সূচনা। তার দাড়ি, বয়স, বর্ণ ও মুসলিম পরিচয় সব মিলিয়ে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। এটি দেখাবে, নিউইয়র্কের রাজনীতিতে ভিন্নতা এবং বৈচিত্র্য কিভাবে প্রভাব ফেলে।

জোহরান বলেন, “আমি আমার পরিচয়, সংস্কৃতি এবং দাড়ি নিয়ে কখনও আপস করব না। এটি শুধুমাত্র একটি ব্যক্তিগত স্টাইল নয়, বরং একটি শক্তিশালী বার্তা যে বৈচিত্র্যকে স্বাগত জানানো হবে।”

MAH – 13760 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button