দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সীমান্তে। আফগানিস্তানের মাটিতে জঙ্গি তৎপরতা ও পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর ক্রমবর্ধমান হামলার প্রেক্ষাপটে ইসলামাবাদ থেকে এসেছে কড়া হুঁশিয়ানি। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন—প্রয়োজনে পাকিস্তান আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে সামরিক অভিযান চালাতে পারে।
জঙ্গিদের আশ্রয় দেয়ার অভিযোগে আফগান সরকারকে দায়ী করছে পাকিস্তান
পাকিস্তানের অভিযোগ, আফগানিস্তানের ভেতর থেকেই জঙ্গিরা হামলা চালাচ্ছে পাকিস্তানের বিভিন্ন সীমান্ত অঞ্চলে। বিশেষ করে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে সাম্প্রতিক আত্মঘাতী হামলাগুলোর সঙ্গে আফগান তালেবান-সম্পৃক্ত গোষ্ঠীর যোগসূত্র রয়েছে বলে দাবি করেছে ইসলামাবাদ।
একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেন,
“আমরা দেখেছি সাম্প্রতিক দুই হামলায় সন্ত্রাসীরা আফগান সীমান্তের ভেতর থেকে এসে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে। তাই আফগানিস্তানের ভেতরে হামলার সম্ভাবনাকে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না।”
তিনি আরও বলেন, আফগান সরকার যদি নিজেদের মাটিতে জঙ্গিদের আশ্রয় দেয়া বন্ধ না করে, তাহলে পাকিস্তান “নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা” নিতে বাধ্য হবে।
তালেবান সরকারের প্রতিক্রিয়া ও পাকিস্তানের প্রত্যাখ্যান
আফগানিস্তানের তালেবান সরকার সাম্প্রতিক হামলাগুলোর নিন্দা জানালেও পাকিস্তান তা বিশ্বাস করতে রাজি নয়। খাজা আসিফ বলেন,
“এই ধরনের নিন্দা শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। আন্তরিকতার কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি। তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের ভেতর থেকেই পাকিস্তানবিরোধী গোষ্ঠীগুলো কার্যক্রম চালাচ্ছে।”
তিনি উল্লেখ করেন, পাকিস্তান বহুবার কূটনৈতিক পর্যায়ে তালেবান সরকারের কাছে অভিযোগ তুলেছে যে ‘তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)’-এর সদস্যরা আফগান মাটিতে নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছে।
আসিফের ভাষায়,
“তালেবানরা যদি সত্যিই সন্ত্রাসবাদ বিরোধী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে চায়, তাহলে প্রথমেই তাদের আফগান মাটিতে পাকিস্তানবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর উপস্থিতি বন্ধ করতে হবে।”
ইসলামাবাদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে
২০২৫ সালের অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে পাকিস্তানে অন্তত ২০টির বেশি ছোট-বড় সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। এর বেশিরভাগই সীমান্তবর্তী এলাকায়, যেখানে আফগান সীমান্ত মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে।
দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে সাম্প্রতিক হামলায় পাকিস্তানের সেনা সদস্যসহ বহু বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে কয়েকটি হামলার দায় স্বীকার করেছে টিটিপি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, তালেবানরা ২০২১ সালে আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করার পর থেকেই টিটিপি নতুন করে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। পাকিস্তানের অভিযোগ—আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালেবানরা টিটিপিকে সরাসরি সমর্থন না দিলেও তাদের দমন করছে না।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের উদ্বেগ
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সম্ভাব্য সংঘাত নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, তারা দুই দেশের মধ্যে ‘সংলাপের মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনের’ আহ্বান জানাচ্ছে।
জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্রও বলেছেন,
“আফগানিস্তানের মাটিকে কোনো দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য ব্যবহার করা যাবে না—এটাই আন্তর্জাতিক নীতি।”
চীন, যা পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র, তারাও বিষয়টি নিয়ে নীরব পর্যবেক্ষণ করছে। তবে বেইজিং বরাবরই দুই দেশের স্থিতিশীল সম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
আফগানিস্তান: তালেবান সরকারের চাপে কূটনৈতিক সংকট
তালেবান সরকারের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ এক বিবৃতিতে বলেন,
“আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চাই। আফগানিস্তানের ভূখণ্ড থেকে কোনো দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেয়া হবে না।”
তবে বাস্তবে এই প্রতিশ্রুতির প্রমাণ খুব কমই দেখা গেছে। আফগান সীমান্তে কার্যত কোনো কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। তালেবান প্রশাসনও সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি বজায় রাখতে পারছে না।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে চলমান অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকটের কারণে তালেবান সরকার অনেক ক্ষেত্রেই সীমান্ত নিরাপত্তা অগ্রাধিকার দিতে পারছে না।
ভারতের প্রসঙ্গেও সতর্কবার্তা দিলেন খাজা আসিফ
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভারতের দিকেও কড়া ভাষায় সতর্কবার্তা দেন। তিনি বলেন,
“আমরা কোনো দেশকেই প্রথমে আক্রমণ করি না। কিন্তু কেউ যদি পাকিস্তানের নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কাজ করে, আমরা কঠোর জবাব দেব।”
ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক নিয়ে পাকিস্তান বরাবরই সন্দেহ প্রকাশ করে আসছে। ইসলামাবাদের অভিযোগ—ভারত আফগানিস্তানের ভেতরে পাকিস্তানবিরোধী তৎপরতায় গোপনে সহায়তা দিচ্ছে। যদিও ভারত এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
পাকিস্তানের নিরাপত্তা নীতিতে নতুন মোড়
খাজা আসিফের সাম্প্রতিক বক্তব্য পাকিস্তানের নিরাপত্তা নীতিতে নতুন এক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এতদিন ইসলামাবাদ সীমান্তের ভেতরে প্রতিরক্ষা কৌশলেই সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু এখন তারা ‘প্রতিরোধমূলক আঘাত’ বা ‘প্রি-এম্পটিভ স্ট্রাইক’-এর কথাও বিবেচনা করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তান হয়তো ভবিষ্যতে আফগান মাটিতে সীমিত পরিসরে সামরিক অভিযান চালাতে পারে, যেমনটি তারা অতীতে করেছিল ‘অপারেশন জারব-ই-আজব’ এর সময়।
দুই দেশের সম্পর্কের ইতিহাস: সংঘাত ও অবিশ্বাসে পূর্ণ
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে জটিল। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় পাকিস্তান আফগান মুজাহিদদের সহায়তা দিয়েছিল, কিন্তু তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে পরিস্থিতি বদলে যায়।
আফগানিস্তান কখনোই পাকিস্তানকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি। আবার পাকিস্তানও মনে করে, আফগানিস্তান ভারতের প্রভাবে চলে।
২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর ইসলামাবাদ ভেবেছিল, নতুন সরকার পাকিস্তানপন্থী হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, দুই দেশের সম্পর্ক ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
সীমান্তে সংঘাত হলে কী ঘটতে পারে
যদি পাকিস্তান সত্যিই আফগান মাটিতে অভিযান চালায়, তাহলে তা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। আফগানিস্তান তখন প্রতিবেশী হিসেবে চীন, ইরান ও রাশিয়ার সমর্থন চাইবে।
অন্যদিকে, পাকিস্তানও পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক ব্যবহার করে কূটনৈতিক সুবিধা নিতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে,
“দুই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সংঘাত হলে তার প্রভাব শুধু সীমান্তে নয়, পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে।”
শান্তির বদলে উত্তেজনা বাড়ছে দক্ষিণ এশিয়ায়
আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সম্পর্ক এখন সূক্ষ্ম ভারসাম্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে সন্ত্রাসবাদ দমনের প্রয়োজন, অন্যদিকে রয়েছে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার বাধ্যবাধকতা।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফের বক্তব্যে যে দৃঢ়তা ও সতর্কবার্তা রয়েছে, তা স্পষ্ট করে দেয়—পাকিস্তান এবার আর সীমান্তপারে সন্ত্রাসী হামলাকে সহজভাবে নিচ্ছে না।
বিশ্লেষকদের মতে, এখন সময় এসেছে দুই দেশকেই বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত নিতে। কারণ আরেকটি সংঘাত শুরু হলে তার মূল্য দিতে হবে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশকেই।
MAH – 13758 I Signalbd.com



