ঢাকার সাভার উপজেলার আশুলিয়ায় ভোররাতে এক চাঞ্চল্যকর অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
বুধবার ভোররাত সাড়ে চারটার দিকে আশুলিয়ার সরকার মার্কেট এলাকায় এই ঘটনাটি ঘটে।
বাসটি ছিল আলিফ পরিবহনের। তখন বাসের ভেতরে ঘুমাচ্ছিলেন চালক মো. সাত্তার। হঠাৎ আগুনের তীব্র উত্তাপে ঘুম ভেঙে যায় তাঁর। প্রাণ রক্ষার জন্য তিনি দ্রুত জানালা দিয়ে লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন। এতে অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যান তিনি।
পরে ডিইপিজেড ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রায় আধা ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে এরই মধ্যে বাসটির ইঞ্জিন, আসন ও অভ্যন্তরীণ অংশ সম্পূর্ণ পুড়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা
সরকার মার্কেট এলাকার একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ভোররাত সাড়ে চারটার দিকে দুটি মোটরসাইকেলে করে চারজন লোক সেখানে আসে। তাঁদের সবার মাথায় হেলমেট ছিল, যাতে মুখ চেনা সম্ভব হয়নি।
তারা বাসটির কাছে এসে খুব দ্রুত কিছু তরল পদার্থ—সম্ভবত পেট্রল—ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যেই বাসে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তারা দ্রুত মোটরসাইকেলে উঠে পশ্চিম দিকের সড়ক ধরে পালিয়ে যায়।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন,
“আমরা তখন দূর থেকে আগুনের আলো দেখি। দৌড়ে এসে দেখি বাসটা জ্বলছে, ভিতরে একজন লোক চিৎকার করছে। পরে সে জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসে।”
চালকের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা
চালক মো. সাত্তার বলেন,
“রাতের ডিউটি শেষ করে গাড়িতেই ঘুমায়া ছিলাম। হঠাৎ আগুনের তাপ পাই। দেখি পুরো গাড়িতে আগুন লেগে গেছে। জানালা দিয়া লাফায়া নামছি। নিচে নামার পর চিৎকার দিয়া লোকজন ডাকছি। দেখি চারজন হেলমেট পরা লোক দুইটা বাইকে ছিল। সিকিউরিটি গার্ড থামাইতে গেছিল, তারা গুলি ছোড়ে। তারপর আগুন দিয়া পালায়।”
চালকের ভাষ্যমতে, দুর্বৃত্তরা খুব পরিকল্পিতভাবে এই হামলা চালায়। তাদের হাতে অস্ত্র ছিল এবং তারা গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে পালিয়ে যায়।
ফায়ার সার্ভিসের বক্তব্য
ডিইপিজেড ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন কর্মকর্তা প্রণব চৌধুরী বলেন,
“ঘটনার খবর পেয়ে আমাদের ইউনিট দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রায় ত্রিশ মিনিটের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে তার আগেই বাসটির অভ্যন্তর সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে—অগ্নিসংযোগটি ইচ্ছাকৃত।”
তিনি আরও জানান, বাসটিতে কোনো বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট বা প্রযুক্তিগত ত্রুটি ছিল না। ফলে অগ্নিকাণ্ডের কারণ হিসেবে সরাসরি নাশকতা বা দুষ্কৃতিকারীর কাজ বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
ঘটনার ধরন ও সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট
এই ঘটনার ধরনটি নতুন নয়। গত কয়েক সপ্তাহে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গীসহ আশেপাশের এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা একাধিক বাসে একই ধরনের অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
মাত্র দুই ঘণ্টা আগে গাজীপুরেও একটি বাসে একইভাবে পেট্রল ঢেলে আগুন দেওয়া হয়। আগুনে বাসটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়, যদিও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ উভয় সংস্থাই মনে করছে—এই ধারাবাহিক অগ্নিসংযোগের পেছনে একটি সংগঠিত গোষ্ঠীর পরিকল্পিত নাশকতা থাকতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত
আশুলিয়া থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে এলাকায় তল্লাশি চালায়। পুলিশের একটি বিশেষ টিম আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে।
আশুলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জানান,
“আমরা ঘটনাস্থল থেকে কিছু পোড়া বোতলের টুকরো ও পেট্রলের গন্ধযুক্ত কাপড় উদ্ধার করেছি। এটি যে নাশকতা, তা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত। কারা এর সঙ্গে জড়িত, তা জানতে তদন্ত চলছে।”
তিনি আরও বলেন, বাসটির মালিক ও চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পাশাপাশি আশেপাশের শিল্পাঞ্চলের সিকিউরিটি পোস্ট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্যামেরা ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ও ক্ষোভ
ঘটনার পর আশুলিয়া ও বাইপাইল এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয়দের আশঙ্কা—এভাবে রাতের আঁধারে ধারাবাহিকভাবে বাসে আগুন দেওয়া হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
স্থানীয় বাসিন্দা রুহুল আমিন বলেন,
“আমরা আতঙ্কে আছি। হঠাৎ কোনো রাতে পাশের বাসে আগুন লাগলে ঘরবাড়িতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ দরকার।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও নিরাপত্তা উদ্বেগ
২০২৫ সালের শেষভাগে এসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছিটেফোঁটা নাশকতার ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি বিভিন্ন স্থানে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, কাঁচ ভাঙচুর ও সড়ক অবরোধের মতো ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে এসেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে পরিবহন খাতে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য এ ধরনের হামলা হতে পারে। পরিবহন সেক্টরকে অচল করে দেওয়া রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির পুরনো কৌশল বলেও তাঁরা উল্লেখ করেন।
বাস মালিক সমিতির প্রতিক্রিয়া
ঢাকা জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন বলেন,
“একদিকে জ্বালানি তেলের দাম, অন্যদিকে কিস্তির চাপ—এই অবস্থায় প্রতিদিন বাসে আগুন দেওয়া পরিবহন ব্যবসায়ীদের জন্য মৃত্যুঘণ্টা। আমরা সরকারের কাছে দাবি করছি, দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার করা হোক।”
তিনি আরও জানান, অনেক চালক এখন রাস্তায় রাতে ঘুমাতে ভয় পাচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে চালক-সহকারীরা ডিউটি করতে রাজি হবেন না, যা সরাসরি সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়াবে।
নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশনা
ঘটনার পর আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন পয়েন্টে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ডিইপিজেড)-এর নিরাপত্তা ইউনিট থেকেও সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, রাতের সময় রাস্তায় দাঁড়ানো বাস, ট্রাক ও পণ্যবাহী যানবাহনের আশপাশে সতর্ক পাহারা বাড়ানো হচ্ছে। শিল্প এলাকাগুলোতে টহল টিমকে ‘রেড অ্যালার্ট’ রাখা হয়েছে।
পূর্ববর্তী ঘটনার সঙ্গে মিল
এই অগ্নিসংযোগের ধরন আগের ঘটনাগুলোর সঙ্গে একেবারেই মিল রয়েছে—
- মোটরসাইকেলে ৩-৪ জন দুর্বৃত্ত আসে।
- পেট্রল বা দাহ্য পদার্থ ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।
- হেলমেট পরে মুখ ঢেকে রাখে।
- কোনো কিছু বলার আগেই দ্রুত পালিয়ে যায়।
এই মিলগুলো দেখে তদন্তকারীরা ধারণা করছেন, একই চক্র একাধিক জেলায় একই ধরনের হামলা চালাচ্ছে।
সতর্কতার সময় এখনই
সাভারের বাসে অগ্নিসংযোগের এই ঘটনা শুধুমাত্র একটি অগ্নিকাণ্ড নয়—এটি একটি বৃহত্তর নিরাপত্তা সংকেত। যাত্রী পরিবহন, শিল্পাঞ্চল, এমনকি শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও নতুন করে ভাবতে হবে।
প্রাণে বেঁচে যাওয়া চালক সাত্তারের মতো অনেকেই হয়তো এত ভাগ্যবান হবেন না। তাই প্রশাসন ও জনগণের সম্মিলিত সচেতনতা এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি।
MAH – 13755 I Signalbd.com



