বাংলাদেশ

ঢাকা ও আশপাশে ১৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন

Advertisement

রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোর সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১৪ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং সম্ভাব্য নাশকতার আশঙ্কায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিজিবি সদর দপ্তর।

বুধবার (১২ নভেম্বর) সকালে বিজিবি সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. শরীফুল ইসলাম এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, “রাজধানী ঢাকাসহ এর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর সার্বিক নিরাপত্তা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিজিবি সদস্যরা মাঠে অবস্থান নিয়েছেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্যান্য ইউনিটের সঙ্গে যৌথভাবে টহল দিচ্ছেন তারা।”

বিজিবির মোতায়েনের পেছনের কারণ

সম্প্রতি কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ আগামী ১৩ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) রাজধানী ঢাকায় ‘লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। দলটির এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে ঢাকায় ককটেল বিস্ফোরণ, যানবাহনে অগ্নিসংযোগসহ বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন সহিংস ঘটনার খবর পাওয়া গেছে।

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেন অবনতি না ঘটে, সেজন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা নেওয়া হয়েছে। রাজধানী ঢাকায় ১২ প্লাটুন এবং আশপাশের জেলা—নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জে আরও দুই প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। মোট ১৪ প্লাটুন বিজিবি সদস্য ইতোমধ্যেই দায়িত্বে যোগ দিয়েছেন।

বিজিবির একাধিক টিম এখন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সঙ্গে যৌথভাবে টহল দিচ্ছে। যানবাহন চেকপোস্ট, গুরুত্বপূর্ণ মোড়, সরকারি স্থাপনা ও কৌশলগত স্থানে মোতায়েন করা হয়েছে সশস্ত্র সদস্যদের।

রাজধানীতে নজিরবিহীন নিরাপত্তা

ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে এখন চৌকস নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে শাহবাগ, মতিঝিল, পল্টন, গুলিস্তান, বনানী, উত্তরা, যাত্রাবাড়ীসহ সব এলাকায় পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি সদস্যরা অবস্থান নিয়েছেন।

সরকারের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এই মোতায়েন কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। যাতে কোনো গোষ্ঠী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে এবং রাজধানীতে স্বাভাবিক জনজীবন বজায় থাকে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “বিজিবির উপস্থিতি রাজধানীতে নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও শক্তিশালী করেছে। পুলিশ ও বিজিবি একসঙ্গে কাজ করছে। যেকোনও পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত।”

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: ১৩ নভেম্বরের রায়কে কেন্দ্র করে উত্তেজনা

চলতি মাসের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু হলো—গণঅভ্যুত্থান মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ। আগামী ১৩ নভেম্বর এই মামলার রায় ঘোষণা করার কথা রয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।

এই রায়কে ঘিরেই আওয়ামী লীগ ঘোষণা করেছে ঢাকায় ‘লকডাউন’ কর্মসূচি। যদিও দলটি দীর্ঘদিন ধরে নিষিদ্ধ, তবে তাদের কর্মীরা এখনও বিভিন্ন স্থানে গোপনে সক্রিয় বলে গোয়েন্দা তথ্য বলছে। প্রশাসনের আশঙ্কা—রায় ঘোষণার দিনকে কেন্দ্র করে নাশকতা, বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে।

ফলে রাজধানীজুড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। শুধু বিজিবিই নয়, র‌্যাব, পুলিশ ও আনসার সদস্যদেরও অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

নাগরিক জীবনে প্রভাব

রাজধানীর বাসিন্দারা এখন এক ধরনের অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ এড়িয়ে চলছেন, অফিসগামীদের মধ্যেও উদ্বেগ দেখা গেছে। বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগামী দুই দিন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মিরপুরের এক বেসরকারি কোম্পানির কর্মকর্তা বলেন, “সকালে অফিসে যাওয়ার পথে তিন জায়গায় চেকপোস্টে থামানো হয়। নিরাপত্তা ভালো, তবে একটু আতঙ্কও কাজ করছে। সবাই এখন পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ার অপেক্ষায়।”

অন্যদিকে, ব্যবসায়ী সমাজও উদ্বিগ্ন। রাজধানীর নিউমার্কেট ও গুলিস্তানের দোকানিরা জানিয়েছেন, বিক্রি আগের তুলনায় কমে গেছে। অনেকে দুপুরের পর দোকান বন্ধ করে দ্রুত বাসায় ফিরছেন।

বিজিবির দায়িত্ব ও অবস্থান

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ সাধারণত সীমান্ত নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত একটি বাহিনী। তবে দেশের অভ্যন্তরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে তারা প্রশাসনের অনুরোধে মাঝে মাঝে দায়িত্ব পালন করে থাকে।

এবারও সরকারের অনুরোধে বিজিবি সদস্যরা রাজধানীতে টহল দিচ্ছেন, যাতে কোনো রাজনৈতিক বা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড দ্রুত প্রতিহত করা যায়।

বিজিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা মূলত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়ক হিসেবে কাজ করছেন। যেকোনও ধরনের গুজব, বিশৃঙ্খলা বা ভাঙচুরের ঘটনায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

সরকারের বার্তা: শান্তি বজায় রাখুন

সরকারের পক্ষ থেকে জনগণকে শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বুধবার বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “যেকোনও ধরনের সহিংসতা বা নাশকতা কঠোর হাতে দমন করা হবে। রাজধানীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিজিবি ও অন্যান্য বাহিনী একসঙ্গে কাজ করছে।”

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতামত

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রায়কে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর (অব.) আনিসুল হক বলেন, “বিজিবি মোতায়েন মানে সরকার কোনো ঝুঁকি নিচ্ছে না। এটি এক ধরনের প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ, যা পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার আগেই স্থিতিশীল রাখবে।”

তিনি আরও বলেন, “যদি এই মোতায়েন পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হয়, তাহলে নাগরিকদের মাঝে আস্থা তৈরি হবে এবং সহিংসতা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।”

বিজিবি কতদিন মাঠে থাকবে

বিজিবি সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই মোতায়েন কার্যক্রম চলবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে ধীরে ধীরে সদস্যদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে।

অন্যদিকে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে—যতদিন রাজনৈতিক কর্মসূচি বা উত্তেজনা অব্যাহত থাকবে, ততদিন বিজিবি মাঠে থাকবে।

রাজধানী ঢাকায় এখন সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি রয়েছে। প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করছে যাতে কোনো গোষ্ঠী পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করতে না পারে। জনগণও শান্তিপূর্ণভাবে দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে যেতে চায়।

সব মিলিয়ে, রাজধানী এখন এক সতর্ক কিন্তু নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে রয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতা ও সরকারের কঠোর অবস্থানই এখন নাগরিকদের ভরসা।

MAH – 13754 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button