ফিলিস্তিনের ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজা উপত্যকায় আবারও বয়ে গেল মৃত্যু ও হতাশার হাওয়া। সোমবার (৩ নভেম্বর) দক্ষিণ গাজায় ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন শিশুসহ তিনজন ফিলিস্তিনি নাগরিক। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা জানায়, এই হামলা সংঘটিত হয়েছে খান ইউনিস অঞ্চলে, যেখানে যুদ্ধবিরতির পর কিছুটা শান্তি ফিরেছিল বলে ধারণা করা হচ্ছিল।
স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে আল-জাজিরা আরও জানায়, নিহতদের মধ্যে একজন মাত্র আট বছরের শিশু এবং বাকি দুজন ছিলেন সাধারণ শ্রমিক। তারা হামলার সময় নিজের ঘরে অবস্থান করছিলেন।
ইসরাইলের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ
গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইসরাইল ইতিমধ্যেই প্রায় ২০০ বারের বেশি যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ করেছেন ফিলিস্তিনের স্থানীয় প্রশাসন। তাদের দাবি, ইসরাইলি বাহিনী কেবলমাত্র স্থল বা আকাশপথেই নয়, কোয়াডকপ্টার ড্রোন ব্যবহার করে গ্রেনেড ও ক্ষুদ্র বোমা নিক্ষেপ করছে বেসামরিক ভবন ও আশ্রয়কেন্দ্রে।
এমন হামলায় গত দুই সপ্তাহে প্রায় ২৫০ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৬০০ জনেরও বেশি। আহতদের অধিকাংশই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ ও নিন্দা
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ইসরাইলের এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেন,
“গাজায় অব্যাহত সহিংসতা শুধু যুদ্ধবিরতির চুক্তিকেই ধ্বংস করছে না, বরং এটি মানবতার মৌলিক নীতিকেও লঙ্ঘন করছে।”
এছাড়া কাতার, তুরস্ক, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকাও এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে,
“শান্তি ও মানবতার নামে যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, ইসরাইল সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে আবারও বেসামরিক মানুষকে হত্যা করছে।”
গাজার বর্তমান পরিস্থিতি: মানবিক বিপর্যয়
গাজায় এখন খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ভয়াবহ সংকট চলছে। জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা UNRWA জানিয়েছে, গাজার প্রায় ২৩ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ বর্তমানে মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।
বিগত এক বছরের যুদ্ধ, হামলা ও অবরোধে পুরো এলাকা কার্যত বাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
এক স্থানীয় শিক্ষক মুহাম্মদ আল-খালিদ বলেন,
“আমরা প্রতিদিন মৃত্যুর আশঙ্কায় বেঁচে আছি। শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না, হাসপাতালগুলোতে ওষুধ নেই, আর রাত নামলেই বোমা ফাটার শব্দ শোনা যায়।”
গাজার দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষত রাফাহ ও খান ইউনিস, আশ্রয়প্রার্থী মানুষের ভিড়ে এখন উপচে পড়েছে। হাজার হাজার মানুষ ধ্বংসস্তূপের মাঝে অস্থায়ী তাঁবুতে বসবাস করছে।
ইসরাইলের দাবি: ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযান’
অন্যদিকে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্রের দাবি, তারা গাজায় “সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান” চালাচ্ছে। ইসরাইলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, হামাস ও ইসলামিক জিহাদ নামের দুটি সংগঠন যুদ্ধবিরতির সুযোগ নিয়ে নতুন করে অস্ত্র মজুদ ও টানেল নির্মাণ করছে।
তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইসরাইলের এই যুক্তি অগ্রহণযোগ্য ও বিভ্রান্তিকর। যুদ্ধবিরতির সময় বেসামরিক এলাকায় হামলা চালানো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের শামিল।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল উভয়েই জানিয়েছে, ইসরাইলের সাম্প্রতিক হামলাগুলো “যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের সুস্পষ্ট প্রমাণ”।
তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC)-এর কাছে এ বিষয়ে তদন্ত শুরুর আহ্বান জানিয়েছে।
HRW-এর মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক পরিচালক ওমর শাকির বলেন,
“ইসরাইলের হামলা এখন আর প্রতিরক্ষার সীমায় নেই; এটি একটি পরিকল্পিত আক্রমণ, যার উদ্দেশ্য গাজার জনগণকে ভয় দেখানো ও স্থানচ্যুত করা।”
শিশুদের ওপর ভয়াবহ প্রভাব
জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ (UNICEF) জানিয়েছে, চলতি বছরের শুরু থেকে গাজায় ১,০০০-এর বেশি শিশু নিহত হয়েছে। আরও হাজারো শিশু আহত বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রজন্মের শিশুদের অনেকেই ভয় ও ক্ষোভে বড় হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলবে।
ইউনিসেফের আঞ্চলিক প্রতিনিধি আদেল খোদর বলেন,
“গাজায় প্রতিটি শিশু এখন একপ্রকার যুদ্ধবন্দি। তারা ভয়ে ঘুমাতে পারে না, খেলতে পারে না, এমনকি অনেক সময় খাবারও পায় না।”
বিশ্বের নীরবতা: প্রশ্নবিদ্ধ মানবতা
বিভিন্ন দেশ ইসরাইলের এই কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলেও বড় শক্তিগুলোর নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কিছু ইউরোপীয় দেশ এখনও ইসরাইলকে “নিজেকে রক্ষা করার অধিকার” বলে সমর্থন জানাচ্ছে।
কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, “রক্ষার অধিকার” কখনোই “নিরপরাধ হত্যার অনুমতি” দিতে পারে না।
বিশ্বজুড়ে নাগরিক সমাজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় #StandWithPalestine ও #CeasefireNow হ্যাশট্যাগগুলো প্রতিদিন ট্রেন্ড করছে।
ইসরাইলি রাজনৈতিক অচলাবস্থা
ইসরাইলের অভ্যন্তরে বর্তমানে রাজনৈতিক চাপও বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের ওপর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে যুদ্ধবিরতি বজায় রাখতে। তবে দেশটির চরমপন্থী রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো যুদ্ধবিরতি “দুর্বলতা” বলে দাবি করছে।
এ অবস্থায় নেতানিয়াহুর সরকার একদিকে আন্তর্জাতিক চাপ, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে।
ফিলিস্তিনিদের প্রত্যাশা: স্থায়ী শান্তি ও ন্যায়বিচার
গাজার জনগণ বলছেন, তারা আর কেবল সাময়িক যুদ্ধবিরতি নয়, স্থায়ী শান্তি ও স্বাধীন রাষ্ট্র চান। ১৯৬৭ সালের সীমান্ত অনুযায়ী পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিই এখন তাদের একমাত্র প্রত্যাশা।
এক তরুণ ফিলিস্তিনি নারী রানিয়া আবু সালেহ বলেন,
“আমরা শান্তি চাই, কিন্তু শান্তি তখনই সম্ভব যখন আমাদের জীবন ও ভূমি নিরাপদ থাকবে। ইসরাইল প্রতিদিন আমাদের ঘর ধ্বংস করছে, সন্তান হত্যা করছে—এরপর কিভাবে শান্তির কথা বলা যায়?”
যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে গাজায় শিশুসহ তিনজন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা নিছক একটি সংখ্যার ঘটনা নয়; এটি মানবতার ওপর নতুন করে আঘাত। প্রতিদিনের এই মৃত্যু ও ধ্বংসের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে এক প্রজন্মের স্বপ্ন।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নৈতিক দায়িত্ব এখনই পদক্ষেপ নেওয়া—যাতে গাজায় মানবতা টিকে থাকে, শিশুরা বাঁচে, এবং শান্তির প্রতিশ্রুতি আবারও বাস্তবে রূপ নেয়।
MAH – 13606 I Signalbd.com



