অর্থনীতি

৬৪৫ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম: নগদের সাবেক এমডি তানভীরসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা

বাংলাদেশের মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’-এর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর এ মিশুকসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অভিযোগে বলা হয়েছে, তারা নিয়ম লঙ্ঘন করে ৬৪৫ কোটি টাকার অবৈধ ই-মানি তৈরি এবং তা লেনদেনের মাধ্যমে আর্থিক অনিয়মে জড়িত ছিলেন।

মামলার পেছনের ঘটনা

মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগ থেকে মামলাটি করা হয়। এই মামলায় ‘নগদ’-এর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর এ মিশুকসহ ২৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৯ জন বাংলাদেশ ডাক বিভাগের কর্মকর্তা রয়েছেন। এছাড়া, অভিযুক্তদের মধ্যে ডাক বিভাগের একজন সাবেক মহাপরিচালকও আছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান গণমাধ্যমকে জানান, “মামলাটি মূলত ৬৪৫ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়মের ভিত্তিতে করা হয়েছে। নগদের পরিচালনায় যে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে, তারই ফলশ্রুতিতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।”

কীভাবে উদঘাটিত হলো অনিয়ম?

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার ‘নগদ’-এর পরিচালনায় প্রশাসক নিয়োগ করে। এই পদক্ষেপের পেছনে মূল কারণ ছিল, নগদের পরিচালনায় বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ। প্রশাসক নিয়োগের পর নিরীক্ষায় বেরিয়ে আসে বেশ কয়েকটি গুরুতর আর্থিক অনিয়ম।

নিরীক্ষায় দেখা যায়, ব্যাংকে নগদ অর্থ জমা না রেখে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার ই-মানি তৈরি করা হয়েছে। এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নিয়মনীতি অনুযায়ী সম্পূর্ণ অবৈধ। এ ধরনের ই-মানি সৃষ্টির ফলে দেশের আর্থিক খাতে একধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হতে পারে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।

সরকারি ভাতার অর্থের অনিয়ম

নিরীক্ষায় আরও একটি গুরুতর অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়েছে। দেখা গেছে, ৪১টি পরিবেশক হিসাব থেকে অননুমোদিতভাবে সরকারি ভাতার ১,৭১১ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। এই টাকা তুলতে কোনো বৈধ অনুমোদন বা নিয়ম মেনে চলা হয়নি। ফলে, এটি সরাসরি প্রতারণা ও জালিয়াতির শামিল।

মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেজবাহ উদ্দিন বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নগদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা তদন্ত শুরু করেছি এবং প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

আইনি প্রক্রিয়া এবং সম্ভাব্য ফলাফল

মামলাটি এখন পুলিশের তদন্তাধীন। তদন্তে প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি দেওয়া হতে পারে। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অপরাধের জন্য বিশেষ ধরনের আইন রয়েছে, যার আওতায় এই মামলাটি বিচারাধীন থাকবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের মামলা দেশের আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের আর্থিক কার্যক্রমে আরও সতর্ক এবং নিয়ম-নীতি মেনে চলার বার্তা দেওয়া হয়।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের অনিয়ম দেশের আর্থিক খাতের জন্য বড় ধরনের হুমকি। একটি এমএফএস প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ ধরনের বিপুল অর্থের অনিয়ম দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। বিশেষ করে, ই-মানি ব্যবস্থায় অনিয়ম থাকলে সাধারণ জনগণের আস্থা হারানোর ঝুঁকি থাকে।

অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, “এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, আর্থিক খাতে নিয়ন্ত্রণ এবং নিরীক্ষার প্রক্রিয়াগুলো আরও শক্তিশালী করা জরুরি। সরকারের উচিত দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষা করা।”

সরকারের অবস্থান

অন্তর্বর্তী সরকারের একজন মুখপাত্র জানান, “নগদে প্রশাসক নিয়োগের পর থেকেই আমরা এই অনিয়মের বিষয়ে সচেতন ছিলাম। সরকার এই ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। কারোই আইনের ঊর্ধ্বে থাকার সুযোগ নেই।”

জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া

সাধারণ জনগণের মধ্যেও এই মামলাটি নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। নগদের গ্রাহকরাও উদ্বিগ্ন, কারণ এ ধরনের মামলার ফলে তাদের লেনদেনে কোনো প্রভাব পড়বে কি না, তা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।

নগদের একজন নিয়মিত গ্রাহক বলেন, “এই ধরনের খবর শুনে আমরা আতঙ্কিত। আমরা চাই, সরকার দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করুক এবং আমাদের লেনদেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুক।”

উপসংহার

নগদের সাবেক এমডি তানভীর এ মিশুকসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা দেশের আর্থিক খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে নয়, বরং সমগ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রয়োজনীয়তাকে সামনে নিয়ে এসেছে। এখন সময়ের দাবি হলো, দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের আইনের আওতায় আনা এবং দেশের অর্থনৈতিক খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।


মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button